পরিবারের আর্থিক সংকটে থেমে যাওয়া জীবন, শেষ পর্যন্ত মর্মান্তিক পরিণতি
যশোরের অভয়নগর উপজেলায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে সুজল সরকার (২৪) নামে এক তরুণের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। রবিবার (২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে উপজেলার হরিশপুর গ্রামে ঘরের পেছনে সেচযন্ত্রের সংযোগের জন্য বিদ্যুতের তার টানানোর সময় এই দুর্ঘটনা ঘটে। সুজল তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন এবং তার অকাল মৃত্যুতে পরিবার ও এলাকাবাসীর মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সুজল সরকার দুপুর সাড়ে ১১টা থেকে ঘেরের জন্য সেচযন্ত্রে বিদ্যুতের তার সংযোগ দিচ্ছিলেন। একপর্যায়ে দুপুর ১২টার দিকে তিনি পাশের বিদ্যুতের আর্থিংয়ের তারের ওপর পড়ে যান এবং তৎক্ষণাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন। সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে অভয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
সুজলের পরিবার জানিয়েছে, ২০১৩ সালে একই সেচযন্ত্রের বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ করার সময় তার বাবা উজ্জ্বল সরকার বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান। এরপর পরিবারের পক্ষ থেকে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কাছে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার আবেদন জানানো হয়, যা কার্যকর করা হয়েছিল। তবে সম্প্রতি ঘেরের পানি সেচে বের করার প্রয়োজন হওয়ায় সুজল নতুন বৈদ্যুতিক মিটার সংগ্রহ করেন এবং পুনরায় সংযোগ স্থাপনের কাজ শুরু করেন। দুর্ভাগ্যবশত, এই কাজ করতে গিয়েই তিনি প্রাণ হারান।
সুজল সরকার ২০২৩ সালে আড়পাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। তবে আর্থিক সংকটের কারণে তিনি আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। সংসারের হাল ধরতে তিনি ইঞ্জিনচালিত ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তার পরিবারের অন্য সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় কর্মরত থাকায় তিনি বাড়িতে একাই থাকতেন। সুজল ছিলেন পরিবারের প্রধান সহায়তাকারী এবং তার মৃত্যুতে পরিবার নিঃসঙ্গ ও অসহায় হয়ে পড়েছে।
অভয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. রাকিবুল ইসলাম বলেন, “মৃত অবস্থায় সুজল সরকারকে হাসপাতালে আনা হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েই তার মৃত্যু হয়েছে।”
অভয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. এমাদুল করিম জানান, “মরদেহের সুরতহাল সম্পন্ন করা হয়েছে এবং আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন। পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ করা হলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
সুজলের মৃত্যুর খবরে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, সুজল একজন শান্তশিষ্ট ও পরিশ্রমী যুবক ছিলেন। পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার জীবন এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। স্থানীয়দের দাবি, বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপনের সময় আরও সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন ছিল।
এই দুর্ঘটনা বিদ্যুৎ সংযোগের ক্ষেত্রে যথাযথ সতর্কতা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা আরও একবার তুলে ধরেছে। বিশেষ করে যারা সাধারণ বিদ্যুৎ সংযোগ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন, তাদের জন্য বিদ্যুতের কাজ করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ করার আগে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক।
বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে:
- প্রশিক্ষিত ইলেকট্রিশিয়ানের সাহায্য নেওয়া: সাধারণ মানুষের বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ না করাই শ্রেয়। প্রশিক্ষিত ইলেকট্রিশিয়ানের সহায়তা নেওয়া উচিত।
- সঠিক নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহার: বিদ্যুৎ সংযোগের সময় গ্লাভস, ইনসুলেটেড জুতা, এবং অন্যান্য সুরক্ষা সামগ্রী পরা উচিত।
- বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে কাজ করা: বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রেখে কাজ করলে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়।
- ভেজা জায়গায় বিদ্যুৎ সংযোগ এড়িয়ে চলা: ভেজা পরিবেশ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। তাই সেচযন্ত্র বা পানির কাছাকাছি বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার।
- সংযোগের আগে মিটার ও তার পরীক্ষা করা: বিদ্যুৎ সংযোগের আগে মিটার, তার ও অন্যান্য সরঞ্জামের অবস্থা ভালোভাবে পরীক্ষা করা উচিত।
সুজল সরকারের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা আমাদের বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও সচেতন হওয়ার শিক্ষা দেয়। অপ্রশিক্ষিত ব্যক্তিদের বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ করা অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে। তাই এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সতর্কতা অবলম্বন করা এবং যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইলেকট্রিশিয়ানের সাহায্য নেওয়া আবশ্যক।
তার পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে, আমরা আশা করি যে, ভবিষ্যতে এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা রোধে স্থানীয় প্রশাসন ও সাধারণ জনগণ আরও সচেতন হবে।