লালমনিরহাটে পুলিশের লাঠিচার্জ ও মহাসড়ক অবরোধ: স্থানীয় জনতার ক্ষোভ
লালমনিরহাটের মোস্তাফিতে একটি কোল্ড স্টোরেজে মাদককারবারী ও চিহ্নিত আওয়ামী লীগের দোসরের সঙ্গে পুলিশের চায়ের আড্ডার ছবি তোলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে ওঠে স্থানীয় ছাত্র-জনতা এবং বিএনপির সহযোগী সংগঠনগুলো। এ ঘটনায় তিন যুবক আটক এবং পুলিশের লাঠিচার্জের পর এলাকায় তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। পরে পুলিশের দুই শীর্ষ কর্মকর্তাকে ক্লোজড করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন লালমনিরহাটের পুলিশ সুপার।
মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) রাত ১১টার দিকে লালমনিরহাট-রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে স্থানীয় বিএনপি এবং এর সহযোগী সংগঠনের শতাধিক নেতাকর্মী। দাবি উঠেছিল সদর থানার ওসি আব্দুল কাদের এবং ডিবি পুলিশের ওসি ফিরোজ হোসেনকে প্রত্যাহারের।
এ ঘটনার সূত্রপাত মোস্তাফির একটি কোল্ড স্টোরেজে ঘটে, যেখানে পুলিশের শীর্ষ দুই কর্মকর্তা স্থানীয় মাদককারবারী ও আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে পরিচিত আখেরের সঙ্গে চায়ের আড্ডায় বসেছিলেন। এই দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করার সময় তিন যুবককে আটক করে পুলিশ। বিষয়টি ছড়িয়ে পড়লে ক্ষোভে ফেটে পড়ে এলাকাবাসী।
অবরোধকারীরা দাবিতে অটল থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা মহাসড়ক অবরুদ্ধ রাখেন। এ সময় পুলিশ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ করে। এতে লালমনিরহাট জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সাত্তারসহ অন্তত ২০ জন আহত হন।
গোকুন্ডা ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাজু বলেন, “ছবি তোলাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান চেয়ে আমরা সেখানে গেলে পুলিশ আমাদের ওপর উগ্র আচরণ করে। পুলিশের নির্যাতনে আমাদের নেতাকর্মীদের অনেকেই আহত হয়েছে।”
সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে
পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠায় সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে এসে ন্যায় বিচারের আশ্বাস দিলে রাতভর আন্দোলনের পর ভোরে অবরোধ তুলে নেয় আন্দোলনকারীরা। তবে লালমনিরহাট সদর থানার ওসি এবং ডিবি পুলিশের ওসিকে প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন স্থানীয় বিএনপি নেতারা।
লালমনিরহাট সদর থানার ওসি আব্দুল কাদের বলেন, “মুন্সিগঞ্জ থেকে আগত পূর্ব পরিচিতের দাওয়াতে আমরা একটি কোল্ড স্টোরেজে গিয়েছিলাম। হঠাৎ তিন যুবক ছবি তুলতে শুরু করলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে জানা যায়, তারা তিনজনই মাদকাসক্ত। তাদের আটক করা হলে কিছু লোক মহাসড়ক অবরোধ করে। শৃঙ্খলা ফেরাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করে।”
তবে পুলিশের এই বক্তব্যে স্থানীয়রা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তারা দাবি করেছেন, পুলিশ চায়ের আড্ডার ছবির সত্যতা ঢাকতে এই ঘটনার দিকে দায় চাপানোর চেষ্টা করছে।
আওয়ামী লীগ ও মাদককারবারীর সংযোগ: জনমনে প্রশ্ন
ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা আখের নামের ব্যক্তিকে স্থানীয়ভাবে একটি মাদক চক্রের নেতৃত্বদানকারী এবং আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিএনপির নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেন, পুলিশের সঙ্গে তার সম্পর্ক এবং প্রভাবের কারণেই এই ঘটনা ঘটেছে।
লালমনিরহাটের ছাত্র-জনতা এবং সাধারণ মানুষ এই ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, পুলিশ প্রশাসনের নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে। এলাকার একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি বলেন, “আমরা আইনের শাসন চাই। যারা মাদককারবারীর সঙ্গে যুক্ত, তারা যে দলেরই হোক, তাদের শাস্তি চাই।”
আন্দোলনের অংশ হিসেবে আজ বিকেলে লালমনিরহাটের স্থানীয় বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর উদ্যোগে একটি প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করা হবে। আহত নেতাকর্মীদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পুলিশের লাঠিচার্জের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।
লালমনিরহাট পুলিশের পুলিশ সুপার তরিকুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, “সদর থানার ওসি এবং ডিবি পুলিশের ওসিকে ক্লোজড করা হয়েছে। আটককৃত তিন যুবককে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে এবং পরিস্থিতি বর্তমানে স্বাভাবিক রয়েছে।”
লালমনিরহাটের এই ঘটনা পুলিশ প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। মাদককারবারী এবং রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে পুলিশের সংযোগ স্থানীয় জনগণের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। যদিও পরিস্থিতি আপাতত স্বাভাবিক, তবে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কী হবে, তা সময়ই বলে দেবে।