এক সাহসী কিশোরীর অকাল প্রস্থান
নাফিসা হোসেন মারওয়া, এক কিশোরী যার স্বপ্ন ছিল প্রবাসী মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে সংসারের দায়িত্ব নেওয়া। তবে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের তীব্র সময়ে তার এই স্বপ্ন ভেঙে যায় এক ঘাতক বুলেটের আঘাতে। ৫ আগস্ট সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডের পাকিজার সামনে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনায় তার জীবন থেমে যায়।
নাফিসার জীবনের এই মর্মস্পর্শী কাহিনী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মঞ্চে তার মতো তরুণদের আত্মত্যাগের কথা।
গাজীপুরের টঙ্গীর দত্তপাড়ার এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন নাফিসা। তার বাবা আবুল হোসেন একজন চা দোকানি এবং মা কুলসুম বেগম একজন কুয়েত প্রবাসী শ্রমিক। পরিবারের অভাব-অনটনের মধ্যে বেড়ে উঠলেও নাফিসা ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী এবং সংগ্রামী।
প্রথমে সাভারের ল্যাবরেটরি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পড়াশোনা শুরু করেন নাফিসা। পরবর্তীতে গাজীপুরে তার বাবার কাছে ফিরে এসে সাহাজুদ্দিন সরকার স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি হন। তার শিক্ষার প্রতি অদম্য ইচ্ছাশক্তি এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ তাকে অন্যান্য শিক্ষার্থীদের থেকে আলাদা করে তুলেছিল।
নাফিসা শুধু একজন শিক্ষার্থীই ছিলেন না; তিনি ছিলেন বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার এক কণ্ঠ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তিনি শুরু থেকেই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করার সাহস দেখিয়েছেন তিনি।
সাভারের পাকিজার সামনে যখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে, তখন নাফিসা ছিলেন আন্দোলনের সামনের সারিতে। ৫ আগস্ট, একটি ঘাতক বুলেট তার বুক ভেদ করে পেছনের দিকে বেরিয়ে যায়। মুহূর্তেই নিস্তব্ধ হয়ে যায় এক সংগ্রামী কিশোরীর কণ্ঠ। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে থেমে যায় তার স্বপ্ন, কিন্তু তার আদর্শ এখনও বহমান।
নাফিসার বাবা আবুল হোসেন মেয়ের মৃত্যুতে শোকাহত। তিনি বলেন, “আমার মেয়ে শুধু নিজের জন্যই নয়, সমাজের জন্যও কিছু করতে চেয়েছিল। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন পূরণ হলো না।”
তার মা কুলসুম বেগম, যিনি প্রবাসে থেকে সংসারের হাল ধরার চেষ্টা করছিলেন, মেয়ের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “আমি ভেবেছিলাম একদিন মেয়ে আমার পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু আজ সে আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গেল।”
নাফিসার মৃত্যু শুধু তার পরিবার নয়, পুরো সমাজকে কাঁদিয়েছে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার আত্মত্যাগ নতুন প্রজন্মের জন্য একটি অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। শিক্ষার্থীদের মাঝে তার সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের গল্প আরও বেশি সচেতনতা এবং ঐক্যের প্রেরণা জোগাবে।
নাফিসার আত্মত্যাগ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সমাজে বৈষম্য এবং অন্যায় দূর করতে হলে শিক্ষিত ও সচেতন প্রজন্ম গড়ে তোলার প্রয়োজন। তার মতো শিক্ষার্থীরা দেখিয়ে দিয়েছেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বয়স কোনো বাধা নয়।
নাফিসা হোসেন মারওয়া ছিলেন এক সাহসী কিশোরী, যিনি বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। তার এই আত্মত্যাগ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সমাজের প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের দাঁড়াতে হবে। তার স্মৃতি আমাদের মনে সাহস এবং প্রেরণার চিরস্থায়ী উৎস হয়ে থাকবে।
নাফিসার মতো সাহসী কিশোরীদের প্রতি আমাদের সম্মান জানানো এবং তাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হওয়াই হবে তার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা।