অনলাইন ডেস্ক
চট্টগ্রামে সিআইডির পুলিশ সুপার (এসপি) শাহনেওয়াজ খালেদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অনিয়ম, হয়রানি ও চোরাচালান নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ উঠেছে। একাধিক সূত্রে জানা যায়, সরকারি দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা কাজে লাগিয়ে তিনি তদন্তে পক্ষপাতিত্ব ও নিরীহ লোকজনকে হয়রানি করে অর্থ আদায়ে জড়িত ছিলেন।
পিটিয়ে জবানবন্দি: নিরীহদের হয়রানি
শাহনেওয়াজ খালেদের বিরুদ্ধে অন্যতম গুরুতর অভিযোগ হলো পিটিয়ে আসামিদের কাছ থেকে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেওয়া। তার নির্দেশে নির্দিষ্ট কিছু নাম শিখিয়ে দেওয়া হতো আসামিদের। পরে জবানবন্দিতে উল্লেখিত নিরীহ লোকজনকে গ্রেপ্তার করে তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতেন।
২০২২ সালে রিয়াজ উদ্দিন বাজারের ব্যবসায়ী রবিউল হাসান (ছদ্মনাম) জানান, তাকে হঠাৎ সিআইডির একটি দল তুলে নিয়ে যায় এবং স্বর্ণ চোরাচালানের অভিযোগে মোটা অঙ্কের অর্থ দাবি করে। টাকা দিতে না পারায় মামলায় ফাঁসানো হয়। রবিউলের মতো আরও একাধিক ব্যবসায়ী জানান, তাদের বৈধ ব্যবসার পরেও শাহনেওয়াজ খালেদের চক্র তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে অর্থ আদায় করত।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ও তদন্তে পক্ষপাত
শাহনেওয়াজ খালেদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছে তার আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠতা ও তদন্তে পক্ষপাতমূলক আচরণের জন্য। ২০২০ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে সিগারেটের অবৈধ চালান তদন্তের সময় সাবেক মেয়র আবদুস সবুর লিটন ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের নাম উঠে আসে। ভ্যাট গোয়েন্দাদের রিপোর্টে তাদের সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ থাকলেও সিআইডির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তাদের নাম বাদ দেওয়া হয়।
একইভাবে চোরাচালানের মামলায় অভিযুক্তদের রক্ষা করতে তিনি আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের নাম ব্যবহার করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতার অপব্যবহার
চট্টগ্রামের রিয়াজ উদ্দিন বাজার, যা চোরাচালান ও হুন্ডির জন্য berই পরিচিত, শাহনেওয়াজ খালেদের কার্যক্রমের কেন্দ্রস্থল ছিল। চোরাচালানের মামলার বেশিরভাগই সিআইডিতে নেওয়া হতো, এবং তদন্তের আড়ালে অর্থ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে।
২০২১ সালের নভেম্বরে চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে চার কেজি স্বর্ণের চালানসহ এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়। আটক ব্যক্তি তদন্তে জানায়, স্বর্ণগুলো রিয়াজ উদ্দিন বাজারের এক ব্যবসায়ীর জন্য আনা হয়েছিল। কিন্তু শাহনেওয়াজ খালেদ এই ব্যবসায়ীকে জিম্মি করে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করেন।
ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন
২০২৩ সালের ১৬ জুলাই চট্টগ্রামের মুরাদপুরে ছাত্র-জনতার সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়। ঘটনাটি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করতে শাহনেওয়াজ খালেদ ছাত্রদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী ও নাশকতাকারী হিসেবে প্রতিবেদন দেন।
এই ঘটনায় ছাত্রদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালানো হয়, যা নিয়ে সমালোচনা ওঠে। তার এই কর্মকাণ্ড নিয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অভিযোগ জমা পড়লেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বিভাগীয় শাস্তি: নামমাত্র পদক্ষেপ
শাহনেওয়াজ খালেদের বিরুদ্ধে একাধিক বিভাগীয় অভিযোগ থাকলেও তার প্রভাবের কারণে সেগুলোর তদন্ত প্রভাবিত হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০২২ সালে তার বিরুদ্ধে একটি বিভাগীয় মামলা হলেও তা নামমাত্র শাস্তি দিয়ে মীমাংসা করা হয়। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের চাপে তাকে সতর্ক করে ছেড়ে দেওয়া হয়।
শাহনেওয়াজ খালেদের বক্তব্য
এসপি শাহনেওয়াজ খালেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি দাবি করেন, তার দায়িত্ব পালনের সময় আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, তবে কোনো পক্ষপাতমূলক কাজ করেননি। চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগকেও তিনি ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেন।
তবে ছাত্রদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেওয়ার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
উপসংহার
শাহনেওয়াজ খালেদের কর্মকাণ্ড নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলছে। চোরাচালান থেকে ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনার ঘটনাগুলো তার প্রভাবশালী অবস্থানের অপব্যবহারকে ইঙ্গিত করে। তবে তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় প্রশাসনিক দুর্বলতা ও রাজনৈতিক প্রভাবের প্রশ্ন সামনে চলে আসে।