গাজার ওপর ইসরায়েলের সাম্প্রতিক আক্রমণ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। এ পদক্ষেপ ইসরায়েলের যুদ্ধনীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। একই সঙ্গে, ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের সামরিক শাখার নেতা মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধেও একই ধরনের পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
আইসিসি নেতানিয়াহু এবং গ্যালান্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে যে, গাজার জনগণের বিরুদ্ধে ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় চলমান যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে খাদ্য, পানি, ওষুধ এবং অন্যান্য মানবিক সাহায্যের প্রবেশে পরিকল্পিত বাধা দেওয়া হয়। এ ছাড়া, ইসরায়েলি বাহিনী গাজার হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্স এবং স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে আক্রমণ করেছে বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে।
গাজায় ইসরায়েলের সামরিক কার্যক্রমে ব্যাপক বোমা হামলা এবং সাধারণ মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি করিম খান এ বিষয়ে বলেন, “গাজাবাসীদের উপর পরিকল্পিত ক্ষুধা চাপিয়ে দেওয়া এবং তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণে বাধা দেওয়া অপরাধমূলক কাজ, যা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে।”
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার মাধ্যমে আইসিসি এই দুই নেতাকে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছে। তবে যতক্ষণ পর্যন্ত তারা গ্রেপ্তার না হন, ততক্ষণ পর্যন্ত বিচার শুরু করা সম্ভব নয়। কারণ, আইসিসি অভিযুক্তদের অনুপস্থিতিতে বিচার পরিচালনা করতে পারে না।
আইসিসির এমন উদ্যোগ নজিরবিহীন নয়। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের দায়ে আইসিসি ইতিমধ্যে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। যদিও এখন পর্যন্ত এই পরোয়ানাগুলো কার্যকর হয়নি, তবে এগুলো অভিযুক্তদের আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করতে ভূমিকা রাখছে।
লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নেভ গর্ডন মনে করেন, আইসিসি নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী মামলা দাঁড় করাতে পারবে। তার মতে, ইসরায়েলের নেতারা খাদ্য এবং চিকিৎসাকে গাজাবাসীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন—এমন প্রমাণ পাওয়া সহজ হবে।
তিনি বলেন, “ইসরায়েল দুই দশক ধরে গাজায় ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। এই অভিপ্রায় সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ড এবং নেতাদের প্রকাশ্য বক্তব্য থেকে স্পষ্ট।”
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর থেকে নেতানিয়াহু এবং গ্যালান্ট আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিপদে পড়তে পারেন। আইসিসি সদস্য রাষ্ট্রগুলোর যেকোনো একটিতে ভ্রমণ করলে তাদের গ্রেপ্তারের সম্ভাবনা থাকবে। রোম সনদে স্বাক্ষরকারী ১২৪টি দেশের সরকার এই পরোয়ানা বাস্তবায়নে বাধ্য।
তবে বাস্তবতা বলছে, এটি সহজ কাজ নয়। উদাহরণ হিসেবে, পুতিনের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করা হলেও তিনি এখনো নিরাপদে আছেন। তদুপরি, ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র আইসিসির সদস্য না হওয়ায় সেখানে পরোয়ানা কার্যকর হওয়ার সুযোগ নেই।
আইসিসির এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নেতানিয়াহু এবং গ্যালান্টের অবস্থান দুর্বল করবে। বিশেষত, ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে তাদের প্রবেশ সীমিত হতে পারে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা এই পরোয়ানাকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে ইসরায়েলি সরকার এটিকে “ইহুদিবিদ্বেষী” আখ্যা দিয়ে নিন্দা জানিয়েছে।
ফিলিস্তিনের পক্ষ থেকে এই পরোয়ানাকে ন্যায়বিচারের একটি ধাপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ফিলিস্তিনের কূটনীতিক এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে।
আইসিসি’র এই পরোয়ানার ভবিষ্যৎ অনেকাংশেই আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চাপ এবং আইনি প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করবে। পরোয়ানা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আইসিসির নিজস্ব কোনো পুলিশি ক্ষমতা নেই। ফলে, এটি কার্যকর করতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ওপর নির্ভর করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ মামলাটি দীর্ঘমেয়াদি হবে এবং আইসিসি’র অবস্থান আরও দৃঢ় করতে পারে।
নেতানিয়াহু এবং গ্যালান্টের বিরুদ্ধে আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার ইস্যুতে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। যদিও এর কার্যকারিতা এবং প্রভাব এখনও অনিশ্চিত, তবে এটি যুদ্ধাপরাধের জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
এই পরোয়ানা শুধু ইসরায়েলি নেতাদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিপথকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেনি, বরং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ফিলিস্তিনে চলমান সংকটের প্রতি নতুন করে মনোযোগ দিতে বাধ্য করেছে।