বাজারে গরু, খাসি এবং মুরগির মাংসের দামে স্থিতিশীলতা থাকলেও মাছের ক্ষেত্রে চিত্র ভিন্ন। দীর্ঘদিন ধরে মাছের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে থাকায় ক্রেতারা অসন্তোষ প্রকাশ করছেন। তবে বিক্রেতারা বলছেন, মাছের ফিডের দাম বাড়ার ফলে উৎপাদন খরচ বেড়েছে, যা বাজারে প্রতিফলিত হচ্ছে। এর ফলে মাছের দামে কোনো স্বাভাবিকতা ফিরে আসছে না।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে মাংসের দামে স্থিতিশীলতা দেখা গেছে। বর্তমানে ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ১৯০ টাকায়, সোনালি মুরগি ২৮০ টাকায়, লেয়ার মুরগি ৩০০ টাকায় এবং দেশি মুরগি ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গরুর মাংস বাজার ভেদে প্রতি কেজি ৭৫০ থেকে ৭৮০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে, আর খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১১০০ টাকায়।
অন্যদিকে মাছের বাজার পুরোপুরি উল্টো চিত্র তুলে ধরেছে। বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, চাষের কই ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা, পাঙাশ ২০০ টাকা, তেলাপিয়া ২৫০ টাকা, শিং ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা, কাঁতল ৩২০ থেকে ৩৮০ টাকা, রুই ৩৬০ টাকা, গলসা ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা, ট্যাংরা ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা এবং রুপচাঁদা ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এর পাশাপাশি চিংড়ি মাছের দাম প্রতি কেজি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা এবং বোয়াল ৮০০ থেকে ৯০০ টাকার মধ্যে রয়েছে।
মাছের দামের ঊর্ধ্বগতিতে ক্রেতারা হতাশা প্রকাশ করছেন। মহাখালী বাজারে মাছ কিনতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী শহীদুজ্জামান মীর বলেন,
“মাছে ভাতে বাঙালি সেই কথাটি আর নেই। এখন মাছ খাওয়া যেন বিলাসিতা হয়ে গেছে। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য কেবল পাঙাশ, তেলাপিয়া বা চাষের কই-ই ভরসা। এগুলো ছাড়া অন্য মাছ কেনার সামর্থ্য আমাদের নেই।”
মগবাজারের ক্রেতা মোজাম্মেল হকের বক্তব্যও প্রায় একই রকম। তিনি বলেন,
“মাছের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে মানুষ হয়তো মাংসের মতো মাছ খাওয়াও ছেড়ে দেবে। এত দাম দিয়েও মাছ কেনার পর ভালো মান পাওয়া যায় না। বাজারে কোনো প্রকার নিয়ন্ত্রণ না থাকায় বিক্রেতারা নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম চেয়ে বসে থাকেন।”
মাছের দাম বাড়ার বিষয়ে শান্তিনগর বাজারের মাছ বিক্রেতা আমিনুল ইসলাম বলেন,
“মাছের ফিডের দাম বেড়ে যাওয়ায় মাছ চাষিদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। তার প্রভাব সরাসরি পাইকারি বাজারে পড়েছে। আমরা পাইকারি বাজার থেকে যে দামে মাছ কিনি, সেটির সঙ্গে পরিবহন খরচ, দোকান ভাড়া এবং অন্যান্য খরচ যোগ করে খুচরা দামে বিক্রি করি। এতে আমাদের লাভ খুব বেশি নয়। যদি পাইকারি বাজারে দাম কমত, তাহলে আমরাও খুচরা বাজারে কম দামে বিক্রি করতে পারতাম।”
তিনি আরও বলেন, মাছ চাষের বিভিন্ন উপকরণের দাম যেমন ফিড, ওষুধ এবং শ্রম খরচ অনেক বেড়েছে। এতে করে চাষিরা আগের তুলনায় কম মাছ উৎপাদন করছেন। এর ফলে চাহিদা ও সরবরাহের ব্যবধান সৃষ্টি হচ্ছে, যা বাজারে উচ্চমূল্যের কারণ।
তবে ক্রেতারা মনে করছেন, মাছের বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হচ্ছে। ক্রেতা মোজাম্মেল হক বলেন,
“বাজারে গেলে দেখা যায়, মাছের সরবরাহ ভালো। কিন্তু দাম অনেক বেশি। বিক্রেতারা দাম ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে রাখেন। অথচ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাজার মনিটরিং করছে না। দীর্ঘদিন ধরে এমন পরিস্থিতি চললেও কেউ কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।”
মাছের দাম বাড়তে থাকায় অনেকেই বিকল্প খাবারের দিকে ঝুঁকছেন। গরু বা খাসির মাংসের দাম স্থিতিশীল থাকলেও বেশিরভাগ মানুষ ব্রয়লার মুরগি বেছে নিচ্ছেন। মহাখালী বাজারের ক্রেতা রেজাউল করিম বলেন,
“মাছের চেয়ে মাংস এখন অনেক সস্তা। ব্রয়লার মুরগি ১৯০ টাকা কেজি, অথচ তেলাপিয়া বা পাঙাশের দামও প্রায় একই। তবু মাংস খেলে পুষ্টি বেশি পাওয়া যায়। তাই মাছের বদলে মাংস খাওয়াই ভালো মনে হচ্ছে।”
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মাছের বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
1. বাজার মনিটরিং বাড়ানো: সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
2. উৎপাদন খরচ কমানো: মাছ চাষিদের জন্য ভর্তুকি প্রদান এবং মাছের ফিডের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
3. সরবরাহ বাড়ানো: মাছ চাষে প্রণোদনা দিলে উৎপাদন বাড়বে এবং বাজারে সরবরাহ স্থিতিশীল হবে।
4. বিক্রেতা সিন্ডিকেট ভাঙা: পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দাম বাড়ানোর প্রবণতা বন্ধ করতে হবে।
মাছ বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য উপাদানগুলোর একটি। কিন্তু বর্তমানে মাছের উচ্চমূল্যের কারণে তা অনেকের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রুত হস্তক্ষেপ না হলে সাধারণ মানুষ মাছ খাওয়ার অভ্যাস ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে। তাই বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।