দীর্ঘ ২০ মাস বন্ধ থাকার পর আবারও ভারত থেকে চাল আমদানি শুরু হয়েছে। সম্প্রতি বেনাপোল বন্দর দিয়ে চালবোঝাই ট্রাকগুলো বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, যা দেশের খাদ্য বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা হচ্ছে। চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার এই আমদানির অনুমোদন দিয়েছে, যা দেশের খাদ্য সুরক্ষায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
গত রোববার (১৭ নভেম্বর) রাতে ভারত থেকে চালবোঝাই তিনটি ট্রাক বেনাপোল বন্দরের ট্রান্সশিফমেন্ট ইয়ার্ডে প্রবেশ করে। এই চালানে মোট ১০৫ টন (এক লাখ পাঁচ হাজার কেজি) নন-বাসমতি চাল আমদানি করা হয়েছে। যশোরের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মাহাবুবুল আলম ফুড প্রোডাক্ট এই চালগুলো আমদানি করেছে। আরও ১০০ টন চাল বেনাপোল বন্দরে প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে।
বেনাপোল চেকপোস্ট উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের উপসহকারী হেমন্ত কুমার সরকার জানান, এই চালানটি ভারত থেকে আসার পর প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। এর ফলে স্বাস্থ্যকর এবং মানসম্মত চাল বাংলাদেশে বাজারজাত করা সম্ভব হবে।
বেনাপোল বন্দর থেকে চাল খালাসের দায়িত্বে থাকা সিএন্ডএফ (ক্লিয়ারিং এন্ড ফরওয়ার্ডিং) এজেন্ট হোসেন অ্যান্ড সন্স-এর ম্যানেজার কাজল হোসেন জানিয়েছেন, আমদানি করা চালের মোট মূল্য ৪৫ হাজার ১৫০ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৫৪ লাখ ১৮ হাজার টাকা। প্রতিকেজি চালের আমদানি মূল্য দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫২ টাকা। এলসি (লেটার অফ ক্রেডিট), এক্সপোর্ট, পরিবহন, বন্দরের ভাড়া, ব্যাংক খরচসহ অন্যান্য খরচ যোগ করলে প্রতিকেজি চালের মোট খরচ দাঁড়ায় ৫৫ টাকা।
এই চালের প্রথম চালান সোমবার বিকেলে বন্দর থেকে ডেলিভারি হওয়ার কথা রয়েছে।
২০২৩ সালের ২০ জুলাই ভারত সরকার সিদ্ধ ও আতপ চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, যা বাংলাদেশে চালের বাজারে সরাসরি প্রভাব ফেলেছিল। তবে, বর্তমান বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় এবং দেশের খাদ্য মজুদ বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ সরকার আবারও ভারত থেকে চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয় ১১ নভেম্বর ২৪টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে চাল আমদানির অনুমতি প্রদান করে। এর আওতায় মোট ১ লাখ ২০ হাজার টন সিদ্ধ চাল এবং ৫৫ হাজার টন আতপ চাল আমদানি করা হবে। আমদানিকৃত চাল আগামী ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে বাজারজাত করতে হবে বলে সরকার শর্ত আরোপ করেছে।
সরকারের পক্ষ থেকে চাল আমদানির জন্য নির্দিষ্ট শর্তাবলী নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য শর্তগুলো হল:
1. বরাদ্দপ্রাপ্ত আমদানিকারকদের আগামী ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পূর্ণ চাল বাজারজাত করতে হবে।
2. আমদানিকৃত চালের পরিমাণ, গুদামজাত ও বাজারজাতকরণের তথ্য সংশ্লিষ্ট জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রককে অবহিত করতে হবে।
3. বরাদ্দের অতিরিক্ত কোনো আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে না।
4. আমদানিকৃত চাল অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের নামে পুনরায় প্যাকেটজাত করা যাবে না।
5. আমদানিকৃত চাল কেবলমাত্র বস্তায় বিক্রি করতে হবে, যাতে বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে থাকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত থেকে চাল আমদানির ফলে বাংলাদেশের বাজারে চালের মূল্য কিছুটা হলেও স্থিতিশীল হতে পারে। সম্প্রতি দেশজুড়ে চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছিল, যা সাধারণ মানুষের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই আমদানির মাধ্যমে দেশের খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে প্রতিবছর ধান উৎপাদন হলেও বিভিন্ন কারণে বছরে কিছু চাল আমদানি করতে হয়। বিশেষ করে খরা, বন্যা বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশের খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হলে আমদানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
যশোরের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মাহাবুবুল আলম ফুড প্রোডাক্টের মালিক মাহাবুবুল আলম বলেন, “ভারত থেকে চাল আমদানির মাধ্যমে আমরা দেশের বাজারে চালের সরবরাহ বাড়াতে এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব। তবে শর্ত অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চাল বাজারজাত করা একটি চ্যালেঞ্জ হবে।”
বেনাপোল কাস্টমস হাউসের ডেপুটি কমিশনার রবিন্দ্র সিংহা বলেন, “আমদানির প্রক্রিয়া সহজ ও দ্রুত করতে আমরা সব ধরনের সহায়তা প্রদান করছি। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, দেশের খাদ্য মজুদ বৃদ্ধি করা এবং চালের বাজারে স্থিতিশীলতা আনা।”
বাংলাদেশ সরকার চাল আমদানির মাধ্যমে খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তবে শর্ত অনুযায়ী দ্রুত বাজারজাতকরণের প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হলে আমদানিকারকদের জরিমানা বা শাস্তির সম্মুখীন হতে হতে পারে।
বাংলাদেশের খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই ধরনের পদক্ষেপ প্রয়োজনীয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর উদ্যোগের মাধ্যমে ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এছাড়া, দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষকদের আরও সহায়তা প্রদান করা জরুরি।
সরকারের এই পদক্ষেপ দেশের খাদ্য পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে। আমদানিকৃত চাল দ্রুত বাজারজাত করা গেলে বাজারের চাপ কমবে এবং সাধারণ মানুষের জন্য চালের দাম কিছুটা হলেও সহনীয় হবে।
ভারত থেকে দীর্ঘ ২০ মাস পর চাল আমদানির সিদ্ধান্ত দেশের খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে। সরকারের কঠোর শর্তাবলী মেনে আমদানি করা চাল দ্রুত বাজারজাত করতে পারলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি অনেকাংশে কমবে। আমদানিকারকদের যথাযথ পদক্ষেপ এবং সরকারের কার্যকর তত্ত্বাবধান এই উদ্যোগকে সফল করতে সহায়ক হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।