ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। এস আলম গ্রুপের অধীনে ব্যাংকটির কার্যক্রম নিয়ে নানা বিতর্কের মধ্যে সম্প্রতি নতুন উদ্যোগ ঘোষণা করা হয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ জানিয়েছেন, ব্যাংকটির অবস্থা স্থিতিশীল করতে এস আলম গ্রুপের শেয়ার বিক্রি করে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকে আজ অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেন ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ। তিনি জানান, এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংকের ১৭টি শাখা থেকে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এই বিশাল ঋণের কারণে ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে শুরু করে এবং ব্যাংকের আন্তর্জাতিক সম্পর্কও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তিনি আরও জানান, ব্যাংকের পুরোনো সৌদি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান আল রাজি গ্রুপকে পুনরায় ব্যাংকের সাথে যুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থা আইএফসি (ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন) কে শেয়ারহোল্ডার হিসেবে যুক্ত করার প্রচেষ্টা চলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সব ব্যাংকের স্থিতিশীলতা রক্ষায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে। পরিচালনায় পরিবর্তন আনার পরও কিছু ব্যাংক এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। তাই তাদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে, সব আমানতকারীকে সুরক্ষা প্রদান করা হবে এবং কোনো ব্যাংক ধ্বংস হতে দেওয়া হবে না।
আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, যারা অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। তবে একই সাথে ব্যাংকের কার্যক্রমকে সচল রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও গ্রহণ করা হবে।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডে ২০১৭ সালে মালিকানা পরিবর্তনের পর থেকে ব্যাংকটির বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার ছাড়তে শুরু করেন। ইসলামী ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি), দুবাই ইসলামী ব্যাংক, কুয়েত ফাইন্যান্স হাউস, ইসলামিক ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড কর্পোরেশন দোহাসহ বিভিন্ন বিদেশি শেয়ারহোল্ডার ধীরে ধীরে তাদের শেয়ার ছেড়ে দেয়। এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর বিদেশি শেয়ারহোল্ডারদের সংখ্যা ও অংশীদারিত্ব কমে আসে। বর্তমানে ব্যাংকটির প্রায় ১৩ শতাংশ শেয়ার বিদেশিদের হাতে রয়েছে যা একসময় ৫০ শতাংশেরও বেশি ছিল।
এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর বিভিন্ন বিতর্ক ও অর্থনৈতিক দুর্বলতা প্রকাশ পায়। ব্যাংকটির শেয়ার বিক্রি করে ১০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের উদ্যোগ ব্যাংকটির আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠতে সহায়ক হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ ব্যাংকের সাম্প্রতিক উন্নয়ন সম্পর্কেও কথা বলেন। তিনি জানান, গত তিন মাসে ব্যাংকের আমানত প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রবাসী আয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে নতুন বিনিয়োগ বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। ব্যাংকের ২,৭০০ এজেন্ট পয়েন্টে তিনজন করে কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, যারা ব্যাংকের আমানত সংগ্রহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানান, ব্যাংক খাতের সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন আনার পরেও যেসব ব্যাংক কার্যকরভাবে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না, তাদের বিশেষ পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছে। ব্যাংকের সঙ্গে বিনিয়োগ, উৎপাদন ও সরবরাহ সরাসরি জড়িত থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকা অত্যন্ত জরুরি। এজন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকেই ধ্বংস হতে দেওয়া হবে না বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশ্বাস দিয়েছে।
এমনকি এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে। ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগে আদালতে মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে। আদালতের রায়ের মাধ্যমে এস আলম গ্রুপের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে।
এই শেয়ার বিক্রি এবং পুনর্গঠনের উদ্যোগ ইসলামী ব্যাংকের স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার ও আস্থার সংকট কাটিয়ে উঠতে সহায়ক হতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদী সফলতা পেতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং ইসলামী ব্যাংককে আরও কার্যকর ও নিরপেক্ষ পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডে এস আলম গ্রুপের ঋণ সংক্রান্ত বিতর্ক ব্যাংকটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। তবে বর্তমান পুনর্গঠনের উদ্যোগ ব্যাংকটির পুনরুজ্জীবন ও আমানতকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে সহায়ক হতে পারে। যদি এই উদ্যোগ সফল হয়, তবে তা ব্যাংকটির জন্য একটি নতুন সূচনা হতে পারে।
ইসলামী ব্যাংকের ভবিষ্যৎ কার্যক্রম কেবল সময়ই বলে দেবে, তবে বর্তমান পদক্ষেপগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে আর্থিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা উজ্জ্বল।