বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সম্প্রতি আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন (কপ২৯) চলাকালে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি সরকারের মেয়াদ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন। ড. ইউনূস ইঙ্গিত দিয়েছেন, ভবিষ্যতে দেশের সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছরের পরিবর্তে চার বছর হতে পারে। তার বক্তব্যে উঠে এসেছে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা, মেয়াদ, এবং সামগ্রিক সরকার ব্যবস্থা সংস্কারের পরিকল্পনা।
বাংলাদেশের প্রচলিত সংবিধান অনুযায়ী, একটি সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর। তবে ড. ইউনূস সম্প্রতি তার সাক্ষাৎকারে বলেন, জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে নতুন সংবিধানে সরকারের মেয়াদ চার বছর করা হতে পারে। তার ভাষায়, “মানুষ সরকারের মেয়াদ কম চায়। সুতরাং, নতুন সরকারের মেয়াদ চার বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ হতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা অন্তর্বর্তী সরকার। আমরা স্থায়ী সরকার নই।” এর মাধ্যমে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মূল লক্ষ্য দ্রুত সময়ের মধ্যে দায়িত্ব সমাপ্ত করা। তবে, তিনি স্পষ্ট করে বলেননি যে এই মেয়াদ ঠিক কতদিন হবে। তার মতে, এটি নির্ভর করবে জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের উপর।
ড. ইউনূস তার সাক্ষাৎকারে আরও উল্লেখ করেন, “বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য হলো সংস্কার কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া।” তিনি জানান, “মানুষ নতুন কিছু চায়। সেখান থেকে পুরো সরকার ব্যবস্থা এবং সংবিধান সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা উঠে এসেছে।” এর জন্য বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠন করার পরিকল্পনাও রয়েছে বলে তিনি জানান।
তার বক্তব্য অনুসারে, এই অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ দুটি ধাপে বিভক্ত—একদিকে নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং অন্যদিকে দেশব্যাপী সংস্কার কার্যক্রম চালানো। ড. ইউনূস জোর দিয়ে বলেন, “আমাদের উদ্দেশ্য যত দ্রুত সম্ভব এই প্রক্রিয়া শেষ করা। তবে, রাজনৈতিক দলগুলো যদি নির্বাচনের আগে সংস্কার প্রক্রিয়া শেষ করতে চায়, তাহলে সেটিও বিবেচনায় নেওয়া হবে।”
ড. ইউনূস উল্লেখ করেন, যদি রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন এগিয়ে আনার দাবি জানায়, তাহলে সরকার সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে। তার মতে, “আমি বলিনি যে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ চার বছর হবে। আমি বলেছি, এটি সর্বোচ্চ মেয়াদ হতে পারে। তবে আমাদের উদ্দেশ্য তা নয়। আমাদের লক্ষ্য দ্রুততার সঙ্গে কার্যক্রম শেষ করা।”
ড. ইউনূসের বক্তব্যে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হবে জনগণের চাহিদা ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে।
ড. ইউনূসের বক্তব্যে যে নতুন সরকার ব্যবস্থার সম্ভাব্য রূপরেখা উঠে এসেছে তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হতে পারে। তিনি বলেন, “পুরো সরকার ব্যবস্থা সংস্কার হবে। এমনকি সংবিধানও সংস্কার করা হচ্ছে।” এই পরিবর্তনের উদ্দেশ্য হলো, জনগণের জন্য আরও কার্যকর, স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
তার মতে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন নিশ্চিত করতে কাজ করছে। এটি এমন একটি সরকার ব্যবস্থা তৈরি করবে যা শুধুমাত্র একটি সাধারণ নির্বাচন নয়, বরং জনগণের দীর্ঘমেয়াদি চাহিদার প্রতিফলন ঘটাবে।
ড. ইউনূসের এই ঘোষণার পর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
বিএনপি’র প্রতিক্রিয়া: বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “এটি সরকারের নতুন নাটক হতে পারে। আমরা চাই দ্রুত নির্বাচন। তবে সরকারের মেয়াদ কমিয়ে আনার বিষয়টি জনগণের জন্য ভালো হতে পারে।”
আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া: আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মন্তব্য করেন, “ড. ইউনূসের এই উদ্যোগ যদি সত্যিই জনগণের স্বার্থে হয়, তবে আমরা এটি স্বাগত জানাই। তবে এটি শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক চাল হতে পারে কিনা, তা নিয়ে আমাদের সন্দেহ আছে।”
বিশ্লেষকদের মতে, ড. ইউনূসের এই উদ্যোগ দেশের রাজনীতিতে নতুন দিকনির্দেশনা দিতে পারে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আবদুল মতিন বলেন, “সরকারের মেয়াদ চার বছর করা হলে তা সরকারের জবাবদিহিতা ও জনগণের প্রতি দায়িত্বশীলতা বাড়াতে পারে। তবে এটি কার্যকর করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয় প্রয়োজন।”
অন্যদিকে, মানবাধিকার কর্মী নাসিমা আক্তার বলেন, “এই পরিবর্তন যদি বাস্তবায়ন করা যায়, তবে এটি জনগণের জন্য একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হবে। তবে এর জন্য স্বচ্ছ প্রক্রিয়া এবং জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে।”
সাধারণ মানুষও সরকারের মেয়াদ চার বছর করার প্রস্তাব নিয়ে মতামত প্রকাশ করেছে। ঢাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, “সরকারের মেয়াদ কমানো হলে জনগণ দ্রুত পরিবর্তন দেখতে পাবে। তবে এর বাস্তবায়ন যেন স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে হয়।”
চট্টগ্রামের গৃহিণী সুলতানা পারভীন বলেন, “নতুন সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে যদি জনগণের কল্যাণ হয়, তবে তা অবশ্যই স্বাগত। তবে রাজনৈতিক দলগুলো যেন এই সুযোগকে অপব্যবহার না করে।”
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের মেয়াদ চার বছর করার ইঙ্গিত এবং পুরো সরকার ব্যবস্থার সংস্কার করার পরিকল্পনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে। তবে, এই পরিবর্তন কতটা কার্যকর হবে তা নির্ভর করবে জনগণের মতামত, রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন, এবং স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ প্রক্রিয়ার উপর।
আসন্ন মাসগুলোতে দেখা যাবে, এই উদ্যোগ দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে কতটা সফল হতে পারে। তবে, ড. ইউনূসের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে তা বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনে সহায়ক হতে পারে।