বাংলাদেশের গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প একসময় দেশজুড়ে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। গ্রামীণ জীবনে মাটির হাঁড়ি, সরা, কলস, মুড়ি ভাজার খোলা, ভাটি, মঠ, ও অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র তৈরি করে মৃৎশিল্পীরা নিজেদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতেন। প্রাচীনকাল থেকে বাংলায় এই শিল্পের সাথে জড়িত কুমার বা কুম্ভকার সম্প্রদায়, বিশেষত হিন্দু পাল সম্প্রদায়ের লোকেরা। কিন্তু বিশ্বায়ন ও আধুনিক প্রযুক্তির আগ্রাসনে এই প্রাচীন শিল্পটি আজ বিলুপ্তির পথে।
বর্তমানে পীরগাছা উপজেলার দুধিয়াবাড়ী কুমারপাড়ার চিত্রটি অত্যন্ত করুণ। একসময় যে গ্রামে শতাধিক পরিবার মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল, সেখানে এখন মাত্র ৪০টি পরিবার কোনোভাবে টিকে আছে। তবুও বাপ-দাদার ঐতিহ্য ধরে রাখতে গুটিকয়েক পরিবার এখনও মাটি দিয়ে জিনিসপত্র তৈরি করে যাচ্ছে। তবে তাদের জীবনে নেমে এসেছে চরম অনটন।
সরেজমিনে দুধিয়াবাড়ী কুমারপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, কেউ দইয়ের সরা তৈরি করছেন, কেউবা নার্সারির টব বানাচ্ছেন। তৈরিকৃত মাটির জিনিসগুলো রোদে শুকাতে দেওয়া হয়েছে। কোথাও আবার সেগুলো পোড়ানোর জন্য চুল্লির উপর সাজানো হচ্ছে। সবকিছুই চলছে প্রচণ্ড পরিশ্রম ও কঠোর মেহনতের মাধ্যমে, তবে এর পরেও আয়ের উৎস অত্যন্ত সীমিত।
৮০ বছরের বৃদ্ধ রামদাস পাল জানালেন, ‘‘আগে মাটির হাঁড়ি-পাতিলের ব্যাপক চাহিদা ছিল। কিন্তু এখন স্টিল, মেলামাইন, প্লাস্টিক ও সিলভারের তৈজসপত্রের প্রচলন বেড়ে যাওয়ায় মাটির জিনিসের চাহিদা একেবারে কমে গেছে। আমাদের কাজের মাটি এলাকাতেও পাওয়া যায় না, দূর উপজেলা থেকে কিনতে হয়। মাটি কেনা, ট্রাক ভাড়া, এবং জ্বালানির খরচ বাদ দিলে কিছুই হাতে থাকে না।’’
আতশি রানি পাল জানান, ‘‘প্রায় ৩০০ নার্সারির টব বানাতে তিন থেকে চার দিন সময় লাগে। সেগুলো বিক্রি করতে পারি মাত্র ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকায়। এতে মাটি, জ্বালানি ও অন্যান্য খরচ বাদ দিলে আমাদের হাতে কিছুই থাকে না। সংসার চালানোই কঠিন হয়ে যাচ্ছে, ছেলে-মেয়েদের ভালোভাবে পড়ানো তো অনেক দূরের কথা।’’
সুমতী রানী নামে এক নারী মৃৎশিল্পী অভিযোগ করেন, ‘‘অনেক সাংবাদিক, গবেষক আসে; ছবি তোলে, ভিডিও করে, কিন্তু সাহায্য আসে না। আমরা কেমন করে বেঁচে আছি, তা কেউ দেখে না। সরকারি সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে গেছি।’’ এই অভিযোগই প্রতিফলন ঘটায় কুমার সম্প্রদায়ের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার।
পীরগাছা উপজেলার সমাজসেবা অফিসার মো. এনামুল হক বলেন, ‘‘মৃৎশিল্পকে ধরে রাখতে সরকার কাজ করছে। আমরা ইতোমধ্যে জরিপ করে তালিকা ঊর্ধ্বতন দফতরে পাঠিয়েছি এবং তাদের সন্তানদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া, অন্যান্য ভাতাও চালু রয়েছে।’’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নাজমুল হক সুমন বলেন, ‘‘কুমার সম্প্রদায় আমাদের ঐতিহ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের টিকিয়ে রাখতে প্রশিক্ষণ ও ঋণ সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।’’ তবে বাস্তব পরিস্থিতি বলছে ভিন্ন কথা—এই সুবিধাগুলোর প্রভাব এখনও কুমারদের জীবনে তেমনভাবে পৌঁছায়নি।
কুমারপাড়ার মৃৎশিল্পীদের মতে, আধুনিকতার ছোঁয়ায় মাটির তৈরি জিনিসের চাহিদা কমে গেছে। স্টিল, প্লাস্টিক ও মেলামাইনের সহজলভ্যতা এবং সাশ্রয়ী মূল্য মাটির পণ্যের প্রতিযোগিতা কমিয়ে দিয়েছে। আগে যে মাটির হাঁড়ি-পাতিল, সরা বা বদনার প্রচলন ছিল, এখন সেগুলোর জায়গা দখল করেছে আধুনিক পণ্য।
মৃৎশিল্পীরা জানান, মাটির চাহিদা যেমন কমে গেছে, তেমনি মাটি পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে। ভালো মানের মাটি আনার জন্য দূরবর্তী উপজেলা থেকে ট্রাকে করে আনতে হয়। এর সঙ্গে জ্বালানির দামও বেড়েছে। ফলে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেলেও বিক্রির মূল্য তেমন বাড়েনি।
এই পরিস্থিতিতে, মৃৎশিল্পীরা পেশা বদলে অন্য কাজ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকেই এখন দিনমজুর বা রিকশা চালক হিসেবে কাজ করছেন। তবে বংশ পরম্পরায় চলে আসা ঐতিহ্য ধরে রাখার আকাঙ্ক্ষা অনেকের মন থেকে এখনও মুছে যায়নি।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকার এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। কুমার সম্প্রদায়ের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, ঋণ সুবিধা, এবং বাজারজাতকরণের সুযোগ বাড়াতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মৃৎশিল্পীদের জন্য সরকার যদি নির্দিষ্ট ভর্তুকি বা বিশেষ প্রণোদনা দেয়, তাহলে এই শিল্প পুনরায় বিকশিত হতে পারে। একইসঙ্গে, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মাটির জিনিসপত্রের প্রচার ও বিপণনের মাধ্যমে এই শিল্পকে আবারও জনপ্রিয় করা সম্ভব।
একসময় বাংলার প্রতিটি ঘরে মাটির জিনিসপত্র ছিল আবশ্যক। আজ, কুমার সম্প্রদায়ের সেই প্রাচীন ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। যন্ত্র ও আধুনিক পণ্যের দাপটে মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। তবে সঠিক দিকনির্দেশনা ও সহযোগিতা পেলে এখনও এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব।
কুমার সম্প্রদায়ের একজন বৃদ্ধা বলছিলেন, ‘‘আমরা তো আর কিছু পারি না। জীবনের শেষ দিনগুলোতেও যদি মাটির হাঁড়ি-পাতিল বানিয়ে যেতে পারি, তবেই আমাদের বংশ পরম্পরার ঋণ শোধ করতে পারব।’’ সরকারের যথাযথ সহায়তা ও সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে কুমারদের জন্য এই প্রাচীন শিল্পকে আবারও সজীব করা সম্ভব। কারণ, মৃৎশিল্প শুধুমাত্র একটি পেশা নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।