তাবলিগ জামাত, বিশ্বজুড়ে শান্তি ও ইসলামের দাওয়াত প্রচারের জন্য পরিচিত একটি ধর্মীয় সংগঠন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে সংগঠনটির মধ্যে বিভাজন এবং উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। এর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ঢাকার কাকরাইল মারকাজ মসজিদ, যা তাবলিগ জামাতের বাংলাদেশ শাখার প্রধান কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত।
প্রায় সাত বছর আগে তাবলিগ জামাতে ভাঙন দেখা দেয়, যার মূলে রয়েছে ভারতের মাওলানা সাদ কান্ধলভী ও বাংলাদেশের মাওলানা জুবায়ের অনুসারীদের মধ্যে মতপার্থক্য। এই দ্বন্দ্বের জেরে তাবলিগ জামাত দুটি মূল ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে: সাদপন্থি ও জুবায়েরপন্থি। এর পর থেকেই কাকরাইল মসজিদে কার্যক্রম পরিচালনা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে।
সরকারের হস্তক্ষেপে ২০১৭ সালে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করা হয়, যার আওতায় কাকরাইল মসজিদে অবস্থানের জন্য সাদপন্থিদের দুই সপ্তাহ এবং জুবায়েরপন্থিদের চার সপ্তাহ সময় বরাদ্দ করা হয়েছিল। তবে এই সিদ্ধান্ত সাদপন্থিরা বৈষম্যপূর্ণ বলে মনে করছিলেন এবং তা নিয়ে তাদের মধ্যে ক্ষোভ জমে ওঠে।
শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) সকাল থেকে কাকরাইল মসজিদ এলাকায় উত্তেজনা দেখা দেয়, যখন সাদপন্থিরা সেখানে অবস্থান নিতে শুরু করেন। সাদপন্থিদের অভিযোগ, জুবায়েরপন্থিরা তাদের নির্ধারিত সময় অতিক্রম করে কাকরাইল মসজিদে স্থায়ীভাবে অবস্থান নিতে চাইছে।
গত ১৩ নভেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাদ অনুসারীরা অভিযোগ করেন, জুবায়েরপন্থিরা সরকারের সিদ্ধান্ত অমান্য করে পুরো কাকরাইল মসজিদ দখলের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা আরও অভিযোগ করেন, জুবায়েরপন্থিরা মসজিদের একটি অংশে মাদ্রাসার নামে স্থায়ী অবস্থান নিয়ে আছেন, যা মূলত তাবলিগের নিয়ম ও নীতিমালার পরিপন্থী।
সাদপন্থিদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, হেফাজতপন্থি আলেমদের সাম্প্রতিক ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে জুবায়েরপন্থিরা কাকরাইল মসজিদ স্থায়ীভাবে দখল নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এর ফলে দুই পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত ও সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সাধারণ মুসল্লি ও তাবলিগের সাথিরা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন, কারণ মসজিদের মতো একটি পবিত্র স্থানে এমন সংঘাতের ঘটনা শুধু ধর্মীয় শান্তির ওপর প্রভাব ফেলবে না, বরং সাধারণ মানুষের জীবনকেও বিপন্ন করতে পারে।
তাবলিগ জামাতের মূল লক্ষ্য ছিল বিশ্বজুড়ে ইসলামের দাওয়াত প্রচার করা এবং মুসলিমদের ধর্মীয় শিক্ষা ও চর্চায় উদ্বুদ্ধ করা। কিন্তু সাম্প্রতিক বিভাজন ও দ্বন্দ্ব তাবলিগের ঐতিহ্য ও মূল মিশনকে বিপর্যস্ত করছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই বিভাজন শুধু বাংলাদেশেই নয়, বরং বিশ্বের অন্যান্য দেশেও তাবলিগ জামাতের কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
সাধারণ মুসল্লিদের মতে, মসজিদ হলো আল্লাহর ঘর এবং এখানে কোনো ধরনের সংঘাত বা বিশৃঙ্খলা হওয়া উচিত নয়। দুই পক্ষের মধ্যে এই ধরনের উত্তেজনা কেবল তাবলিগ জামাতের সুনামকে ক্ষুণ্ণ করছে এবং ইসলামের শান্তিপূর্ণ বার্তাকে ব্যাহত করছে।
সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। বিগত সময়ে, কাকরাইল মসজিদে সশস্ত্র সংঘর্ষের মতো ঘটনাও ঘটেছে, যা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার উভয় পক্ষকে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে বের করার পরামর্শ দিয়েছে। তবে, দুই পক্ষের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সহজ হবে না।
একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, “আমরা চাই উভয় পক্ষ শান্তিপূর্ণভাবে তাদের ধর্মীয় কার্যক্রম চালিয়ে যাক। তবে যদি পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যায়, তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তাবলিগ জামাতের বিভক্তির পেছনে মূলত মতাদর্শগত পার্থক্য কাজ করছে। সাদপন্থিরা মাওলানা সাদ কান্ধলভীর দাওয়াত পদ্ধতি অনুসরণ করেন, যা কিছু মুসলিম আলেমের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে, জুবায়েরপন্থিরা তাবলিগের প্রতিষ্ঠিত ধারা মেনে চলে এবং তারা মনে করেন, মাওলানা সাদের কিছু মতবাদ ইসলামের মূল শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
তবে তাবলিগ জামাতের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব ইসলামের শান্তিপূর্ণ বার্তার পরিপন্থী। মুসলিমদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার জন্য তাবলিগের কার্যক্রম পরিচালিত হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু বিভাজন ও সংঘাতের কারণে সেই উদ্দেশ্য এখন বিপন্ন।
বর্তমান পরিস্থিতিতে তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষের জন্য সমঝোতার পথ বেছে নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মসজিদ ও মারকাজ একটি পবিত্র স্থান, যা ইসলামের প্রচার ও শান্তির বার্তা ছড়ানোর জন্য প্রতিষ্ঠিত। এখানে কোনো ধরনের সংঘাত বা বিভাজন ইসলামের মূল শিক্ষার পরিপন্থী।
তাবলিগ জামাতের উভয় পক্ষের উচিত নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য দূর করে একত্রিতভাবে ইসলামের প্রচার ও দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যাওয়া। এজন্য উভয় পক্ষের নেতৃত্বকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে এবং নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।
মুসলিম উম্মাহর ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও ইসলামের শান্তিপূর্ণ বার্তা ছড়িয়ে দিতে কাকরাইল মসজিদের মতো পবিত্র স্থানগুলিতে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। ইসলামের প্রকৃত উদ্দেশ্যই হলো শান্তি ও সহিষ্ণুতা, যা এই দ্বন্দ্বের মীমাংসার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।