বাংলাদেশে পরিবেশ রক্ষায় বন বিভাগের কার্যক্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কিছু গাছের প্রজাতি যেমন ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি দেশের পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন। এর প্রেক্ষিতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বন অধিদপ্তরে অনুষ্ঠিত এক বিশেষ সভায় ঘোষণা দেন যে, এখন থেকে বন বিভাগ আর ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি গাছ রোপণ করবে না। তার পরিবর্তে পরিবেশ-বান্ধব ও জীববৈচিত্র্য রক্ষাকারী গাছ রোপণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হবে।
ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি গাছ দ্রুত বর্ধনশীল হওয়ায় এবং কাঠের জন্য বেশ জনপ্রিয় হলেও এগুলো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই গাছগুলো মাটির আর্দ্রতা শোষণ করে দ্রুত শুকিয়ে ফেলে, যা ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এছাড়া, ইউক্যালিপটাস গাছের পাতা ও শিকড়ে এমন কিছু রাসায়নিক উপাদান থাকে যা আশপাশের অন্যান্য উদ্ভিদের বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশ উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “আমরা ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি গাছের পরিবর্তে স্থানীয় প্রজাতির বৃক্ষ রোপণ করব যা পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সহায়ক।”
বন অধিদপ্তরের নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, রাস্তার পাশে সামাজিক বনায়নের উদ্দেশ্যে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণির পরিবর্তে অন্যান্য পরিবেশবান্ধব গাছ রোপণের ওপর জোর দেওয়া হবে। এ উদ্যোগের মাধ্যমে কেবল জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা নয়, বরং স্থানীয় জনগণের জন্য বিকল্প আয়ের উৎস সৃষ্টি করা সম্ভব হবে।
পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, “জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বায়োডাইভারসিটি রুলস ও গাইডলাইন তৈরি করা হবে।” এর পাশাপাশি তিনি বন ও বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত কার্যক্রমে রেঞ্জ অফিস পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এতে করে শিক্ষার্থীরা সরাসরি প্রকৃতির সান্নিধ্যে থেকে বন সংরক্ষণে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
বনাঞ্চলের স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখতে এবং বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল সংরক্ষণে ইকো-ট্যুরিজম ও পিকনিক নিষিদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, “ইকো-ট্যুরিজমের নামে বনের ভেতরে উচ্চ শব্দে গান-বাজনা পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। তাই এসব কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।”
বনভূমির অবৈধ দখল উচ্ছেদের জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের কথা উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, “অবৈধ দখলকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের তদবির সহ্য করা হবে না।” এছাড়া, বনবাসীদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব দূর করতে গারো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা বন্ধেরও নির্দেশ দেন তিনি। এই ধরনের পদক্ষেপের মাধ্যমে বনবাসীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে বন সংরক্ষণকে আরো কার্যকর করা যাবে।
পরিবেশ উপদেষ্টা স্ট্রাটেজিক প্ল্যান, জেন্ডার পলিসি এবং গ্রিভেন্স রিড্রেস সিস্টেম কার্যকর করার ওপর জোর দিয়েছেন। প্রকল্পের তথ্য প্রকাশে স্বচ্ছতা আনার জন্য তিনি সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন যাতে জনসাধারণের কাছে প্রকল্প সম্পর্কিত সঠিক তথ্য পৌঁছায়।
তিনি বলেন, “আমরা টেকসই বন ব্যবস্থাপনার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়ন করছি। এই পরিকল্পনার মধ্যে পরিবেশবান্ধব বৃক্ষ রোপণ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, এবং স্থানীয় জনগণের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া হবে।”
বাংলাদেশে বনভূমি সংরক্ষণ ও পরিবেশ রক্ষায় এই নতুন উদ্যোগগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি গাছের পরিবর্তে পরিবেশ-বান্ধব গাছ রোপণ, ইকো-ট্যুরিজমের নিয়ন্ত্রণ, এবং বনবাসীদের অধিকার সংরক্ষণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশের বন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা সম্ভব হবে। বন বিভাগের এই নতুন দিকনির্দেশনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের পথে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।