রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ততম এলাকা ফার্মগেটে সড়ক ও ফুটপাত দখল করে গড়ে ওঠা দোকানপাট উচ্ছেদে যৌথ অভিযানে নেমেছে পুলিশ, সেনাবাহিনী, র্যাব ও সিটি করপোরেশন। মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর ২০২৪) দুপুরে এই অভিযান শুরু হয়, যা প্রায় চার ঘণ্টা ধরে চলে। অভিযানের ফলে শতশত হকার তাদের দোকান হারানোর ক্ষোভে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে।
ফার্মগেট এলাকায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করেন। কিন্তু ফুটপাত ও সড়ক দখল করে দোকান বসানোর কারণে পথচারীদের চলাচলে ব্যাপক ভোগান্তি হচ্ছিল। ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকা সংলগ্ন এই অঞ্চলে সড়ক অবরোধের ফলে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছিল। তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ রুহুল কবীর খান বলেন, “শহরের ব্যস্ততম এলাকায় ফুটপাত দখল মুক্ত করতে অভিযান পরিচালনা করা জরুরি ছিল। সাধারণ মানুষের চলাচলে বাধা সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি অপরাধমূলক তৎপরতাও বাড়ছিল।”
তিনি আরও বলেন, সোমবার (১১ নভেম্বর) হকারদের দোকান সরানোর জন্য মাইকিং করা হয়েছিল। কিন্তু তারা সেই নির্দেশ মানেনি, তাই মঙ্গলবার যৌথ বাহিনীর সহযোগিতায় অভিযান পরিচালিত হয়েছে।
সকাল ১২টা থেকে ফার্মগেটের গ্রিন সুপার মার্কেটের সামনের ফুটপাত থেকে অভিযান শুরু হয়। প্রায় চার ঘণ্টা ধরে চলা এই অভিযানে ফার্মগেট সুপার মার্কেট, আনন্দ সিনেমা হল, তেজগাঁও কলেজের সামনে এবং খামারবাড়ি পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় অবৈধভাবে স্থাপিত প্রায় হাজারখানেক দোকানপাট উচ্ছেদ করা হয়। অভিযানে অংশ নেয় সেনাবাহিনীর তেজগাঁও অস্থায়ী সোনা ক্যাম্পের একটি দল। ক্যাপ্টেন আবরার বলেন, “জননিরাপত্তার স্বার্থে এবং জনসাধারণের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে এ ধরনের অভিযান চালানো হচ্ছে।”
উচ্ছেদ অভিযান শুরুর পরই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ফার্মগেটের হকাররা। তারা নিজেদের দোকান হারানোর ফলে জীবিকার সংকটে পড়ার অভিযোগ তুলেছেন। মো. সিরাজুল ইসলাম নামে এক হকার বলেন, “আমরা পেটের দায়ে রাস্তায় দোকান করি। আমাদের সরিয়ে দিলে কোথায় যাবো? কী করে খাবো, কীভাবে সংসার চালাবো?”
অন্যদিকে, মো. শফিক নামে আরেকজন হকার অভিযোগ করেন, “আগে ফার্মগেটের প্রতিটি দোকান থেকে পুলিশসহ বিভিন্নজন চাঁদা নিতো। তখন কোনও সমস্যা হতো না। এখন চাঁদা না নেওয়ায় আমাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। তাহলে কি তারা আবার চাঁদা নিতে চায়? এটা হতে দেওয়া যাবে না। আমরা বাধ্য হলে কঠোর আন্দোলনে যাবো।”
উচ্ছেদ অভিযানের পর হকাররা দুপুর ৩টার দিকে ফার্মগেট থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। তারা খামারবাড়ি মোড়ে সড়ক অবরোধ করে কয়েকটি গাড়ির ওপর হামলা চালায়। এরপর তারা তেজগাঁও কলেজের সামনে প্রায় আধাঘণ্টা বিক্ষোভ করে এবং আনন্দ সিনেমা হলের সামনে অবস্থান নেয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, হকাররা দফায় দফায় বিক্ষোভ মিছিল করে বিভিন্ন সড়কে যান চলাচল ব্যাহত করেছে। এর ফলে ফার্মগেট ও তেজগাঁও এলাকার যানজট পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ মোহাম্মদ জিয়াউল হক বলেন, “ফুটপাত দখল করে ব্যবসা পরিচালনার কারণে চুরি-ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধ বাড়ছে। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ফুটপাত ও সড়ক থেকে অবৈধ হকারদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে।”
তিনি আরও জানান, এই অভিযান চলমান থাকবে এবং কোনও ধরনের বাধা দিলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যৌথ বাহিনী অভিযান চালিয়ে সড়ক ও ফুটপাত দখলমুক্ত করে জনসাধারণের চলাচল নির্বিঘ্ন করার চেষ্টা করছে।
সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা জানান, ফুটপাত উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার উদ্দেশ্য হচ্ছে ঢাকার অন্যতম প্রধান এলাকাগুলোতে জনসাধারণের চলাচল নির্বিঘ্ন করা। অতিরিক্ত ভিড়, ফুটপাত দখল, এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে আনা অত্যন্ত জরুরি। তিনি বলেন, “ফার্মগেট, মিরপুর রোড, ধানমন্ডি ইত্যাদি এলাকায় দখলমুক্ত রাখতে আমাদের নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে হবে।”
হকারদের দাবি, যদি সরকার বা সিটি করপোরেশন তাদের বিকল্প কর্মসংস্থান বা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে, তাহলে তারা পুনরায় ফুটপাতে দোকান বসাতে বাধ্য হবে। এক হকার বলেন, “আমরা চাই, আমাদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো স্থান বরাদ্দ করা হোক যেখানে আমরা নির্বিঘ্নে ব্যবসা করতে পারি।”
অন্যদিকে, সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ফুটপাত ও সড়ক মুক্ত রাখার এই উদ্যোগ চলমান থাকবে। তবে হকারদের পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান নিয়ে তারা আলোচনার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
ফার্মগেটের উচ্ছেদ অভিযানকে কেন্দ্র করে সামাজিক মাধ্যমে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ এ উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও অনেকে সমালোচনা করেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুনর্বাসন ছাড়া হকারদের উচ্ছেদ করলে তাদের জীবিকা সংকটে পড়বে, যা ভবিষ্যতে আরও বড় সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই যৌথ অভিযানের পাশাপাশি পুনর্বাসনের বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত।
ঢাকার জনসংখ্যার চাপ এবং জনসাধারণের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে ফুটপাত উচ্ছেদ অভিযান চালানো হলেও, হকারদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। হকারদের অভিযোগ ও দাবির প্রতি যথাযথ সমাধান প্রদান না করলে, ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি আবারও তৈরি হতে পারে।
ফার্মগেটের মতো ব্যস্ত এলাকাগুলোতে জনসাধারণের চলাচল নিশ্চিত করতে হলে উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে একটি স্থায়ী সমাধান বের করা জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।