বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে আসিয়ান (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সংস্থা) জোটের সদস্যপদ লাভে প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইন্দোনেশিয়ার সমর্থন কামনা করেছেন। তিনি ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূত হেরু হারতান্তো সুবোলোকে রোববার (৩ নভেম্বর) বিদায়ী সাক্ষাৎকারে জানান যে, আসিয়ানের সদস্যপদ অর্জন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আসিয়ান সদস্যপদ লাভ বাংলাদেশের জন্য একাধিক সুবিধা নিয়ে আসতে পারে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উন্নয়নশীল অর্থনৈতিক গোষ্ঠী হিসেবে আসিয়ান তার সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন এবং শিক্ষায় উন্নয়ন সাধনে ভূমিকা রেখে আসছে। সদস্যপদ পেলে বাংলাদেশ বৈদেশিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ, এবং আন্তঃদেশীয় সহায়তার ক্ষেত্রগুলোতে ব্যাপক সুবিধা লাভ করতে পারবে। দক্ষিণ এশিয়ার একটি সম্ভাবনাময় অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আসিয়ানের সদস্য হলে অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হবে এবং বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অবস্থান আরও সুদৃঢ় হবে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূতকে জানান যে, তিনি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সাম্প্রতিক ঢাকা সফরের সময় আসিয়ান সদস্যপদের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। ইন্দোনেশিয়া আসিয়ানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে অন্যতম হওয়ায় এই দেশটির সমর্থন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রদূত সুবোলো জানান, ইন্দোনেশিয়া আসিয়ান সদস্য হওয়ার জন্য বাংলাদেশের আবেদনের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখবে এবং সম্ভাব্য সহায়তা প্রদান করবে।
সাক্ষাতের সময় দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের প্রসারেও আলোচনা হয়। ড. ইউনূস বাংলাদেশি ব্যবসার প্রসার এবং বিনিয়োগের সুবিধার্থে ইন্দোনেশিয়ায় আরও সুযোগ সৃষ্টি করার আহ্বান জানান। বাংলাদেশ-ইন্দোনেশিয়া সম্পর্ক শক্তিশালী করার লক্ষ্যে, তিনি ইন্দোনেশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আরও বেশি বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর ভর্তির সুযোগ এবং বাংলাদেশি চিকিৎসক নিয়োগের প্রস্তাব রাখেন। ইন্দোনেশিয়া যদি বাংলাদেশ থেকে ওষুধপত্র আমদানি বৃদ্ধি করে, তাহলে উভয় দেশই আর্থিকভাবে উপকৃত হবে বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।
ড. ইউনূস ইন্দোনেশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য আরও বৃত্তি ও সুযোগ তৈরি করার আহ্বান জানান। এ ছাড়া, বাংলাদেশের উচ্চ মানের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের নিয়োগে ইন্দোনেশিয়ার আগ্রহ বাড়ানোর অনুরোধ জানান। এটি উভয় দেশের জন্যই লাভজনক হবে, কারণ বাংলাদেশের দক্ষ চিকিৎসক এবং উন্নত মানের ওষুধের চাহিদা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টর ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ওষুধ উৎপাদন করে আসছে, যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ইন্দোনেশিয়ার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট প্রবোও সুবিয়ানতোকে দায়িত্ব গ্রহণের জন্য অভিনন্দন জানান এবং তাকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। দুই দেশের সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে এই ধরনের উচ্চ পর্যায়ের সফর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ার নতুন নেতৃত্বের অধীনে বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে কৌশলগত অংশীদারিত্ব আরও শক্তিশালী হতে পারে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানো হলে এই অঞ্চলে উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে। ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে উভয় দেশের ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলো যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে, যা দুই দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য উপযোগী। বিশেষ করে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাত ইন্দোনেশিয়ার জন্য আকর্ষণীয় হতে পারে।
রাষ্ট্রদূত হেরু হারতান্তো সুবোলো আশ্বাস দিয়েছেন যে, ইন্দোনেশিয়া বাংলাদেশকে আসিয়ান সদস্যপদ লাভের প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণ সহায়তা প্রদান করবে। এছাড়া, তিনি বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে ব্যবসায়িক সম্পর্ক আরও উন্নত করার প্রয়াসে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
আসিয়ান সদস্যপদ পেলে বাংলাদেশ একাধিক সুবিধা লাভ করবে। আসিয়ান অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি সম্পর্ক সহজ হবে এবং শুল্ক ছাড়ের সুবিধা পাওয়া যাবে। এতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, কৃষি, এবং অন্যান্য পণ্যের বাজার প্রসারিত হবে। পাশাপাশি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পর্যটন এবং প্রযুক্তি খাতে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে দুই দেশের মানুষ উপকৃত হবে।
আসিয়ান সদস্যপদ অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশ শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নয়, বরং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আরও গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছাতে পারবে। তাই আসিয়ান সদস্যপদ লাভের লক্ষ্যে ইন্দোনেশিয়া এবং অন্যান্য সদস্য দেশগুলোর সমর্থন বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য।