ঢাকা, অক্টোবর ৩১: সম্প্রতি দেশের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, অতি মূল্যায়ন এবং আর্থিক অনিয়ম নিয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে অর্থনৈতিক পর্যালোচনা কমিটি। বৃহস্পতিবার অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন ইআরএফ (ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম) আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ সংক্রান্ত নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেন।
সভায় ড. দেবপ্রিয় স্পষ্ট করেন যে, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং, জ্বালানি, ভৌত অবকাঠামো এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতে সবচেয়ে বেশি আর্থিক অনিয়ম পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই খাতগুলোর মেগা প্রকল্পগুলোতে অতি মূল্যায়ন এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যয়কে দায়ী করেন তিনি, যা দেশের অর্থনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য জানান, গত এক দশকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় বেশ কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। তবে এগুলোর সঠিক মূল্যায়ন না হওয়ায় সরকারি অর্থনীতির ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে। তিনি বলেন, “মেগা কাঠামোর নামে যে অতি মূল্যায়িত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হয়েছে, তাতে শুধু সরকারি কোষাগারের উপরই নয়, সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রায়ও প্রভাব পড়েছে।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, অনেক প্রকল্পের পেছনে প্রচুর অর্থ ব্যয় হলেও সেই প্রকল্পগুলো তেমনভাবে কার্যকর হয়নি। ড. দেবপ্রিয়ের মতে, এই অতি মূল্যায়ন কেবল মাত্র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নয় বরং পুরো ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতার অভাবকেই নির্দেশ করে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য দাবি করেন যে, অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ও পরিকল্পনার জন্য প্রয়োজনীয় সরকারি তথ্য-উপাত্তের বিশুদ্ধতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত না থাকায় বিশ্লেষকদের সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। অনেক সরকারি কর্মকর্তা সরকারের চাপের কারণে সঠিক তথ্য প্রকাশ করতে পারেননি বলে তিনি অভিযোগ করেন। ফলে, সঠিক তথ্যের অভাবে অনেক সময় ভুল বিশ্লেষণ তৈরি হচ্ছে এবং অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং খাতে আর্থিক অনিয়ম বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দেশের আর্থিক অবস্থার অবনতির অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ড. দেবপ্রিয় বলেন, “দেশের ব্যাংকগুলোর পরিচালন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব এবং নজরদারির দুর্বলতা অর্থনৈতিক সংকটের একটি বড় কারণ।” তিনি জানান, অনিয়ম রোধে নীতিমালার পর্যালোচনা প্রয়োজন এবং এসব নীতিমালায় দায়বদ্ধতার আরও উন্নতি আনা দরকার।
জ্বালানি এবং অবকাঠামো খাতেও অনিয়ম এবং পরিকল্পনার অভাবের কারণে দেশীয় অর্থনীতির ওপর ব্যাপক চাপ পড়ছে বলে জানান ড. দেবপ্রিয়। দেশের জ্বালানি খাতের উন্নয়নের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হলেও, এই খাতে অনিয়মের কারণে দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট বাড়ছে। জ্বালানি খাতের অব্যবস্থাপনার ফলে সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সঠিক পরিকল্পনার অভাবে প্রকল্পগুলোর লক্ষ্য অর্জিত হয়নি।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও জানান যে, আইসিটি খাতের জন্য বরাদ্দকৃত বাজেটের অনিয়ম এবং যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে দেশের এই খাতে উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ থাকার পরও অর্থায়ন এবং ব্যবস্থাপনায় সুষ্ঠু পরিকল্পনা না থাকায় এ খাতের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
কমিটির পক্ষ থেকে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ফলাফল ও লক্ষ্যগুলো পুনর্বিবেচনা করা হবে বলেও উল্লেখ করেন ড. দেবপ্রিয়। তিনি বলেন, “আমরা সরকারের প্রতি আর্থিক শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতের জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবো। বাজেট প্রণয়নের আগে সরকারের সঙ্গে আমাদের পরামর্শ বিনিময় করা হবে।”
এই শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তাদের কাজ শেষে অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করবে। এতে দেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অবস্থা, আর্থিক অনিয়ম ও নীতি নির্দেশনার প্রস্তাবনা থাকবে বলে জানানো হয়েছে।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী ও স্বচ্ছ করে তোলা। সেই লক্ষ্যে আমরা এই প্রতিবেদন দাখিলের মাধ্যমে সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই।”
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সঙ্কট ও অনিয়মের প্রেক্ষিতে শ্বেতপত্র প্রণয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন এই কমিটি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে আরও সুসংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্ট মহল।