বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল রাঙামাটি, যেখানে পাহাড়, নদী আর লেকের মিলনে সৃষ্টি হয়েছে অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। সেই রাঙামাটি, পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু, সম্প্রতি কিছু নিরাপত্তাজনিত কারণে পর্যটকদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। কিন্তু, সেই বিধি-নিষেধ এবার তুলে নেওয়া হয়েছে, আর পর্যটকরা আবারও রাঙামাটির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। আগামী ১ নভেম্বর থেকে পর্যটকরা এখানে এসে বিভিন্ন আকর্ষণীয় স্থানে ভ্রমণ করতে পারবেন।
গত মাসের ১৮ তারিখ থেকে পাহাড়ি অঞ্চলে কিছু সহিংস ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাঙামাটিতে পর্যটকদের ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। তিন দফায় চলা এই নিষেধাজ্ঞা মূলত পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং স্থানীয় পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে নেওয়া হয়েছিল। প্রথমে ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে ৪ অক্টোবর পর্যন্ত ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়, এবং পরে ৮ অক্টোবর থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা বাড়ানো হয়। কিন্তু পার্বত্য অঞ্চলে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসায় প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ১ নভেম্বর থেকে পর্যটকদের জন্য ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে।
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান ৩০ অক্টোবর তার নিজ কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, “সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামী ১ নভেম্বর থেকে রাঙামাটিতে পর্যটকদের জন্য সব ধরনের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে। পর্যটকদের সব ধরনের নিরাপত্তা দেওয়া হবে এবং রাঙামাটিতে ভ্রমণের ক্ষেত্রে বর্তমানে আর কোনো সমস্যা নেই।”
পার্বত্য এলাকায় পর্যটকদের নিরাপত্তা সবসময়ই প্রশাসনের কাছে অগ্রাধিকারের বিষয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পর্যটকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর করা হয়েছে এবং ভ্রমণের ক্ষেত্রে কোনো ঝুঁকি নেই। পর্যটকরা যাতে নিরাপদে রাঙামাটির দর্শনীয় স্থানসমূহ ঘুরে দেখতে পারেন, সেজন্য পর্যটন এলাকাগুলোতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসক আরও বলেন, “পার্বত্য এলাকায় যেকোনো ঘটনা মোকাবিলায় স্থানীয় প্রশাসন সচেষ্ট থাকবে এবং পর্যটকদের নিরাপত্তায় কোনোরকম আপস করা হবে না।” এই অঞ্চলে পর্যটন সংশ্লিষ্ট কর্মীরা পর্যটকদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত রয়েছে।
রাঙামাটির পাশাপাশি খাগড়াছড়ি জেলার সাজেক ভ্যালিও পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম স্থান। তবে খাগড়াছড়িতে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরও কয়েকদিন স্থায়ী হবে। খাগড়াছড়িতে পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা আগামী ৫ নভেম্বর পর্যন্ত বহাল থাকবে। এরপর পর্যটকরা সাজেক ভ্যালিসহ খাগড়াছড়ির অন্যান্য জায়গায় ভ্রমণ করতে পারবেন।
জেলা প্রশাসকের ভাষায়, “যেহেতু খাগড়াছড়িতে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ৫ নভেম্বর পর্যন্ত থাকবে, তাই ৫ নভেম্বর থেকে সাজেকে পর্যটকদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে।” এর মাধ্যমে সাজেক ভ্যালির স্বপ্নময় সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার সুযোগ পাবেন ভ্রমণপ্রেমীরা।
রাঙামাটিতে পর্যটকদের স্বাগত জানাতে স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। রাঙামাটি আবাসিক হোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মঈন উদ্দিন সেলিম জানিয়েছেন, নভেম্বর মাসজুড়ে রাঙামাটির হোটেল-মোটেলগুলিতে পর্যটকদের জন্য ৩০% ছাড় দেওয়া হবে। এই উদ্যোগ পর্যটকদের আকর্ষণ করবে এবং রাঙামাটিতে ভ্রমণ আরও স্বস্তিদায়ক হবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
মঈন উদ্দিন বলেন, “রাঙামাটিতে আসা পর্যটকদের জন্য আমরা বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা করেছি। এর মাধ্যমে আশা করছি পর্যটকদের ভ্রমণ আরও সুবিধাজনক হবে।”
রাঙামাটি পর্যটকদের জন্য বাংলাদেশে অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। কাপ্তাই লেক, ঝুলন্ত সেতু, শুভলং ঝরনা, রাজবন বিহার, আরণ্যক পার্ক এবং উপজাতীয় জাদুঘরসহ অনেক স্থানের জন্য রাঙামাটি খ্যাত। এগুলো পর্যটকদের মনকে মুগ্ধ করে।
নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ফলে স্থানীয় পর্যটন খাতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। স্থানীয় পর্যটন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা মনে করছেন, পর্যটকদের আগমন বেড়ে গেলে স্থানীয় অর্থনীতির চাকা আরও সচল হবে। এছাড়া স্থানীয় জনগণেরও পর্যটন খাত থেকে সুবিধা লাভের সুযোগ থাকবে।
রাঙামাটিতে ভ্রমণ নির্বিঘ্ন করতে প্রশাসন ও স্থানীয়রা পর্যটকদের প্রতি কিছু সাধারণ শৃঙ্খলা ও নিয়ম মেনে চলার অনুরোধ জানিয়েছেন। প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ রক্ষার জন্য পর্যটকদের সচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে দায়িত্বশীল আচরণ এবং পরিবেশ দূষণ এড়াতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা জরুরি।
অন্যদিকে প্রশাসনও পর্যটকদের সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়েছে। পাহাড়ি এলাকায় ভ্রমণ করার সময় সাধারণত কিছু বিশেষ নিয়মকানুন মানা হয়, যা পর্যটকদের জন্য নিরাপত্তার অংশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া প্রশাসনের পক্ষ থেকে জঙ্গলের ভিতরে বা ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে ভ্রমণ এড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
রাঙামাটি, যেখানে প্রকৃতির নির্জনতা এবং উপজাতীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধন, পর্যটকদের কাছে বরাবরই এক বিশেষ আকর্ষণের স্থান। পর্যটকদের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে রাঙামাটির পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে আবারও উন্মুক্ত হওয়ার মাধ্যমে পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই নভেম্বরের শুরুতে যারা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর পাহাড়ি পরিবেশের প্রশান্তি খুঁজছেন, তাদের জন্য রাঙামাটি হতে পারে সেরা গন্তব্য।