ঢাকার মোহাম্মদপুরে চলমান অপরাধ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে সেনাবাহিনী। রবিবার (২৭ অক্টোবর) দিনব্যাপী এবং রাতের অভিযানে ঢাকা উদ্যান, চাঁদ উদ্যান এবং জেনেভা ক্যাম্প থেকে মোট ২২ জন অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে খুনের আসামি, ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ, মাদক ব্যবসায়ী এবং কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। অভিযানে মোহাম্মদপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ অন্যান্য কুখ্যাত অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে।
মোহাম্মদপুর এলাকায় গত কয়েক মাস ধরে মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি এবং কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে স্থানীয় জনসাধারণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও অপরাধের ভয়াবহতা মাথায় রেখে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ৪৬ স্বতন্ত্র ব্রিগেড এবং স্থানীয় পুলিশ যৌথভাবে অভিযান পরিচালনা করেছে। আইএসপিআর থেকে প্রকাশিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর সুরক্ষার জন্যই এই অভিযান চালানো হয়েছে। সেনাবাহিনী এবং পুলিশ যৌথভাবে কাজ করছে যাতে এলাকাবাসী নিশ্চিন্তে জীবনযাপন করতে পারে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকে।
রবিবারের অভিযানে মোহাম্মদপুরের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা চিরুনি অভিযান চালিয়ে পরিচিত কুখ্যাত সন্ত্রাসী এবং অপরাধীদের আটক করা হয়। ঢাকা উদ্যান, চাঁদ উদ্যান, এবং জেনেভা ক্যাম্পে এই অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযানকালে যে ২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়, তাদের মধ্যে মোহাম্মদপুরের কুখ্যাত তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী আদম বেপারী সেলিম, দুর্ধর্ষ রুহুল গ্যাংয়ের শীর্ষ সন্ত্রাসী ইব্রাহিম এবং সাগর রয়েছে। এই তিনজনই এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে আসছিল এবং স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের ভয়ে দীর্ঘদিন ধরে আতঙ্কে ছিলেন।
অভিযানে কেবল সন্ত্রাসী নয়, জেনেভা ক্যাম্প থেকে মাদক চক্রের দুইজন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়, যাদের নাম স্থানীয়দের কাছে পরিচিত। এছাড়াও, ১০ জন ছিনতাইকারী এবং ৭ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যকে আটক করা হয়। এদের মধ্যে কয়েকজন কিশোর অপরাধীকে স্থানীয়রা চেনেন, যারা নিয়মিত চাঁদাবাজি এবং ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে লিপ্ত ছিল।
মোহাম্মদপুর এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা নতুন কিছু নয়। এলাকাবাসী জানায়, এই কিশোর গ্যাংগুলো মূলত স্থানীয় কিছু সন্ত্রাসীর প্রভাবেই গড়ে উঠেছে। এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি এবং এলাকাবাসীকে হয়রানি করে থাকে। একদিকে পড়াশোনা ছেড়ে অপরাধ জগতে প্রবেশ করা, অন্যদিকে স্থানীয় জনগণের নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি—এসব কারণে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়। কিশোর অপরাধীদের আটক করার ফলে এলাকাবাসীর মাঝে স্বস্তি দেখা দিয়েছে।
মোহাম্মদপুরে সেনাবাহিনীর এই বিশেষ অভিযান সফলভাবে শেষ হওয়ায় সাধারণ মানুষ কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে। স্থানীয়রা জানান, মোহাম্মদপুর এলাকায় কিছু দিন ধরে সন্ত্রাস ও মাদকের কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, “মোহাম্মদপুরের অনেক এলাকাই মাদক এবং ছিনতাইকারীদের জন্য আতঙ্কের জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেনাবাহিনী ও পুলিশের যৌথ অভিযান দেখে মনে হচ্ছে, হয়তো এবার কিছু পরিবর্তন আসবে।”
অন্য এক বাসিন্দা বলেন, “এই অভিযানের মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের মনোবল কিছুটা হলেও দুর্বল হয়েছে। আমরা আশাবাদী, এই ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ অব্যাহত থাকলে এলাকাতে শান্তি ফিরবে।” সাম্প্রতিক সময়ে মোহাম্মদপুরের আশেপাশের এলাকায় চাঁদাবাজির পরিমাণ বাড়ছিল। এর ফলে সাধারণ মানুষ তাদের দৈনন্দিন কাজে নিরাপদ বোধ করছিল না। সেনাবাহিনীর এই কঠোর পদক্ষেপ জনসাধারণের মনে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
আইএসপিআরের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সেনাবাহিনী দেশব্যাপী চলমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পেশাদারিত্বের সাথে কাজ করছে। তারা জানান, দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা রক্ষায় অপরাধ দমন, বিচার বহির্ভূত কার্যক্রম রোধ, এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কঠোর অবস্থান নিয়ে কাজ করছে। আগামী দিনগুলোতেও এই ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে যাতে অপরাধীরা কোনোভাবেই আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যেতে না পারে।
আইএসপিআর আরও জানায় যে, সেনাবাহিনী নিয়মিতভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে অপরাধমূলক কার্যক্রম প্রতিরোধে বিশেষ পদক্ষেপ নেবে। তারা বিশ্বাস করে, এই ধরনের নিরপেক্ষ এবং পেশাদারী পদক্ষেপের মাধ্যমে দেশের সাধারণ জনগণের আস্থা এবং নিরাপত্তা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে।
যদিও সেনাবাহিনীর অভিযান সাধারণ জনগণের জন্য স্বস্তির বাতাস এনেছে, তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, কেবলমাত্র অভিযানের মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। স্থানীয় সামাজিক প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ এবং পরিবারের ভূমিকা অপরিহার্য। কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ এবং মাদক প্রতিরোধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সংস্কৃতি চর্চার উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন। স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে কিশোরদের জন্য বিভিন্ন সৃজনশীল কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে।
স্থানীয় এক স্কুলশিক্ষক বলেন, “শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কিশোরদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারলে তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা কমবে। যারা ইতোমধ্যে অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে তাদের জন্য সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।” এছাড়া, মাদক নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ এবং স্থানীয় প্রশাসনের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য বলে মত দেন তিনি।
মোহাম্মদপুরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর এই অভিযান একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য হচ্ছে। এই অভিযান সাময়িকভাবে এলাকাবাসীর মনে স্বস্তি এনে দিলেও দীর্ঘমেয়াদী শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন সার্বিক আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা, প্রশাসনের শক্ত ভূমিকা এবং স্থানীয় জনগণের সচেতনতা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু সমাজ প্রতিষ্ঠায় সেনাবাহিনীর এই প্রচেষ্টা প্রশংসনীয় এবং আশা করা যায় যে, এই ধরনের উদ্যোগ দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও অপরাধ প্রতিরোধে অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।