বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকারি সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে আমদানি করা বিলাসবহুল গাড়ির গল্প নতুন কিছু নয়। এবার চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, শুল্কমুক্ত সুবিধায় সাবেক সংসদ সদস্যদের আমদানি করা বিলাসবহুল গাড়িগুলো নিলামে বিক্রি করা হবে। প্রথম ধাপে নিলামে উঠবে ২৪টি গাড়ি, যার বাজারমূল্য প্রায় ২৮৮ কোটি টাকা। এসব গাড়ির মধ্যে আছে টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার, বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ বেঞ্জসহ আরও অনেক নামী ব্র্যান্ড। সম্প্রতি চট্টগ্রাম কাস্টমস এই গাড়িগুলোর নিলামের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
সরকারি নীতিমালার আওতায় সংসদ সদস্যরা প্রতি নির্বাচনী মেয়াদে একবার শুল্কমুক্ত সুবিধায় বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করতে পারেন। এটি একটি বিশেষ সুযোগ, যা এমপিদের শুল্কমুক্তভাবে গাড়ি কেনার ব্যবস্থা করে। সংসদ সদস্যদের জন্য সরকার এই সুবিধাটি দিয়ে থাকলেও অনেক সময় তা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। যেমন, এসব গাড়ির ব্যবহার কতটুকু দেশের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় এবং এ সুবিধাটি কেবলমাত্র ব্যক্তিগত লাভের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা—এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এবারের ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদের বেশ কয়েকজন সদস্য শুল্কমুক্ত সুবিধা নিয়ে বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করেছিলেন। কিন্তু ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সরকার পরিবর্তন ও সংসদ ভেঙে দেওয়া হলে এমপিরা সেই গাড়িগুলো ছাড় করাতে ব্যর্থ হন। নিয়ম অনুযায়ী, এসব গাড়ি বন্দরে পৌঁছানোর ৩০ দিনের মধ্যে ছাড় নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও সেই সময়ে তারা শুল্কমুক্ত সুবিধা হারিয়ে ফেলেন। ফলে এই বিলাসবহুল গাড়িগুলো চট্টগ্রাম বন্দরের কার শেডে পড়ে থাকে এবং কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এগুলো বাজেয়াপ্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে।
নিয়ম অনুযায়ী, গাড়িগুলো বন্দর থেকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ছাড় না নেওয়ায় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ নিলামের সিদ্ধান্ত নেয়। চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে গাড়িগুলোর মালিকদের চিঠি দিয়ে নির্দিষ্ট শুল্ক পরিশোধের মাধ্যমে গাড়ি ছাড় নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। ২২ ও ২৩ অক্টোবর মালিকদের প্রথম দফায় চিঠি পাঠানো হয়, যাতে ১৫ দিনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। যদি তারা এই সময়সীমার মধ্যে জবাব না দেন, তবে দ্বিতীয়বার চিঠি দেওয়া হবে। এরপরও জবাব না পেলে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ নিলাম প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করার দিকে এগিয়ে যাবে।
গাড়িগুলো আমদানি করার সময় প্রতি গাড়ির মূল্য ছিল প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা, যা সংসদ সদস্যরা শুল্কমুক্ত সুবিধায় সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে, শুল্কমুক্ত সুবিধা ছাড়া এগুলো ছাড় করাতে চাইলে ৮৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক দিতে হবে। যার ফলে প্রতিটি গাড়ির মোট মূল্য দাঁড়াবে প্রায় ১০ থেকে ১২ কোটি টাকার মতো। এটি এমপিদের জন্য ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং তারা এই বাড়তি অর্থ পরিশোধ করতে অনাগ্রহী। ফলে এই গাড়িগুলো অবশেষে নিলামের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে।
কাস্টমস কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এ ধরনের পদক্ষেপ দেশের শুল্ক ব্যবস্থাপনার সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য জরুরি। এটি কেবল মাত্র নীতি ও আইন প্রয়োগের জন্যই নয়, বরং এতে সরকার বিরোধীদের জন্য একটি সতর্কবার্তা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। দেশের মূল্যবান সম্পদ যাতে অবহেলায় পড়ে না থাকে এবং শুল্কমুক্ত সুবিধার অপব্যবহার না হয়, সেটি নিশ্চিত করাই মূল লক্ষ্য।
তবে এক্ষেত্রে অনেকেই বলছেন, সংসদ সদস্যদের শুল্কমুক্ত সুবিধা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হবে এবং এই সুবিধাটি আসলেই কতটা প্রয়োজনীয় সেটি নতুন করে পর্যালোচনা করা উচিত। কেননা, দেশের আর্থিক সম্পদ যদি ব্যক্তিগত বিলাসিতার জন্য ব্যবহৃত হয় তবে তা জনস্বার্থের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকলস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন, এই ধরনের সুবিধা পেতে সংসদ সদস্যদের দুটি চিঠির প্রয়োজন হয়—একটি এলসি খোলার জন্য এবং আরেকটি গাড়ি শুল্কমুক্ত সুবিধায় ছাড়ের জন্য। তবে, সংসদ বিলুপ্ত হওয়ায় দ্বিতীয় চিঠি নিতে ব্যর্থ হওয়ায় এই গাড়িগুলোর মালিকরা গাড়িগুলো ছাড় করতে পারেননি।
সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান জানিয়ে সংসদ সদস্যদের উচিত এই গাড়িগুলো দ্রুত নিলামের মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া। কেননা, এ ধরনের বিলাসবহুল গাড়ি বন্দর এলাকায় পড়ে থাকায় দেশের মূল্যবান সম্পদের অব্যবহার হচ্ছে এবং এটি দেশের আর্থিক স্বার্থের জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষের এ পদক্ষেপ একটি শক্তিশালী বার্তা বহন করে। সাবেক সংসদ সদস্যদের জন্য এটি একটি শিক্ষা হতে পারে যে, জনস্বার্থকে অবহেলা করে সরকার প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করলে তার চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত দেশের শুল্ক ব্যবস্থাকে সুশাসিত করতে সাহায্য করবে এবং জনমনে সরকারের জন্য ইতিবাচক বার্তা দেবে।
দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির দিকে তাকিয়ে, এ ধরনের পদক্ষেপ কেবলমাত্র আইন মেনে চলার প্রতিফলন নয় বরং এটি একটি সতর্ক সংকেত যা ভবিষ্যতে শুল্কমুক্ত সুবিধার অপব্যবহার রোধ করতে সহায়ক হবে।