দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার জনপ্রিয় অভিনেতা সুরিয়া, পুরো নাম সারাভানন শিবকুমার, যিনি অভিনয় জগতে ‘সুরিয়া’ নামে সুপরিচিত। বাবার পদাঙ্ক অনুসরণে অভিনয়ে আসার কোনো ইচ্ছা ছিল না তার। বরং একজন উদ্যোক্তা হয়ে নিজস্ব পোশাক ব্যবসা শুরু করার পরিকল্পনা ছিল তার। কিন্তু ভাগ্য তাকে নিয়ে আসে ক্যামেরার সামনে, মায়ের ২৫ হাজার রুপি ঋণ শোধ করার তাগিদে অভিনয়ের পেশায় জড়িয়ে পড়েন সুরিয়া, এবং পরবর্তী সময়টি ইতিহাস।
সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে সুরিয়া তার অভিনয়ে আসার গল্প শেয়ার করেছেন। পিঙ্কভিলাকে দেওয়া এই সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, কিভাবে মায়ের অর্থনৈতিক সংকট তাকে অভিনয়ের দিকে টেনে আনে এবং তার জীবন একেবারে পাল্টে দেয়। তিনি বলেন, “আমি টাকার জন্যই ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছি। আমার মায়ের ঋণ শোধ করার উদ্দেশ্য নিয়ে আমি অভিনয়ে প্রবেশ করেছি। এভাবেই আমি আমার ক্যারিয়ার শুরু করি এবং ধীরে ধীরে হয়ে উঠি সুরিয়া।”
মায়ের সাথে একটি কথোপকথন যা জীবন বদলে দেয়
সুরিয়া জানান, তার মা একদিন তাকে জানান যে তিনি ২৫ হাজার রুপি ধার নিয়েছেন, যা তার বাবা শিবকুমার জানেন না। এই কথা শুনে সুরিয়া বিস্মিত হন এবং প্রশ্ন করেন, “আমার বাবা একজন অভিনেতা, তাহলে কেন টাকা ধার করতে হলো? আমাদের সঞ্চয়ের কী হলো?” তখন মায়ের কাছ থেকে জানতে পারেন, পরিবারে কোনো সময়ই সঞ্চয় তেমন ছিল না, ব্যাংক ব্যালান্সও কখনো এক লাখের বেশি হয়নি।
এই পরিস্থিতি সুরিয়ার মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলে এবং তার মনে একটা জেদ জন্মায়। মায়ের এ ঋণ শোধ করতে তিনি অভিনয়ে আসেন, যা ছিল তার জন্য অপ্রত্যাশিত একটি পদক্ষেপ।
পোশাক কারখানায় কর্মজীবনের শুরু
অভিনেতা হওয়ার পূর্বে সুরিয়া একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে কর্মজীবনের প্রথমে তিনি ১৫ দিনে ৭৫০ রুপি পারিশ্রমিক পেতেন, যা তিন বছর পরে মাসিক ৮ হাজার রুপিতে দাঁড়ায়। তার ইচ্ছা ছিল সঞ্চয় করে নিজস্ব কিছু করার, পাশাপাশি বাবার কাছ থেকেও কিছু আর্থিক সহায়তা নিয়ে নিজের ব্যবসা শুরু করার। কিন্তু মায়ের ঋণের বিষয়ে জানতে পারার পর তার স্বপ্ন পরিবর্তিত হয়ে যায়।
পারিবারিক অর্থসংকট ও বাবার অবস্থান
তার বাবা শিবকুমার, যিনি দক্ষিণী সিনেমায় একজন বর্ষীয়ান অভিনেতা হিসেবে পরিচিত, কিন্তু নিজের পারিশ্রমিক নিয়ে কখনো কোনো দাবি করতেন না। নির্মাতারা পারিশ্রমিক পরিশোধ না করা পর্যন্ত তিনি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতেন। সুরিয়া বলেন, “বাবা সব সময়ই এমন ছিলেন। কখনোই তার পারিশ্রমিক নিয়ে ঝামেলা করতেন না। তিনি ১০ মাস কাজ থেকে দূরে থাকায় পরিবারটি অর্থনৈতিকভাবে চাপে পড়েছিল।”
অভিনয়ে প্রবেশ এবং পথচলা
পারিবারিক পরিচয়ে বিভিন্ন কাজের প্রস্তাব পেলেও সুরিয়ার ক্যামেরার সামনে আসার আগ্রহ ছিল না। কিন্তু মায়ের ঋণের চাপ এবং পারিবারিক আর্থিক অবস্থা তাকে বাধ্য করে অভিনয়ে আসতে। অভিনয়ে প্রবেশের পরও প্রথম দিকে কিছুটা অস্বস্তি থাকলেও ক্যামেরার সামনে তার উপস্থিতি দর্শকদের কাছে দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। প্রথম দৃশ্য শুটিংয়ের সময় সেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা হাজার হাজার মানুষ তাকে হাততালি দেয়, যা সুরিয়ার জন্য এক নতুন প্রেরণা হয়ে ওঠে। সেই থেকে সুরিয়া আর পেছনে তাকাননি। তিনি বলেন, “দর্শক প্রজন্ম বদলেছে, দর্শকের পছন্দ বদলেছে, কিন্তু তারা আমাকে নিঃশর্তভাবে ভালোবাসা দিয়ে চলেছে।”
ক্যারিয়ারে উত্থান
ক্যারিয়ারের শুরুতে অভিনয়ে স্রেফ অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে এলেও, সুরিয়া ধীরে ধীরে নিজেকে একজন শক্তিশালী অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। একাধিক জনপ্রিয় সিনেমায় কাজ করে তিনি হয়ে ওঠেন দক্ষিণী সিনেমার অন্যতম প্রধান মুখ। বর্তমানে এমনকি ৪৯ বছর বয়সেও তিনি দর্শকদের জন্য নিখুঁত পারফরম্যান্স উপহার দিতে সিক্স-প্যাক বডি তৈরি করে ফেলেছেন, যা তার কাজের প্রতি নিবেদনের পরিচায়ক।
সুরিয়া অভিনয়ে আসার পেছনের গল্প তার পরিশ্রম, দায়িত্ব এবং পারিবারিক সম্মানের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। তার জন্য মায়ের ঋণ শোধ করতে অভিনয় শুরু করলেও, এখন অভিনয়ই তার পরিচয়। দক্ষিণী সিনেমায় তার এই অসামান্য অবদানে শ্রোতারা আজও তাকে ভালবাসায় সিক্ত করেন।