বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংগঠনের কেউ অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত থাকলে তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলে তিনি জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে প্রস্তুত। তিনি দাবি করেন, সংগঠনের নেতৃত্বের দায়বদ্ধতার পরিবর্তে এসব অপরাধ ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত হওয়া উচিত।
দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, জামায়াতে ইসলামী মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘এক পাকিস্তান’ সমর্থন করেছিল। তবে এটিকে দলের আনুষ্ঠানিক অবস্থান হিসেবে নয়, বরং পরিস্থিতিগত একটি অবস্থান হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত। তার বক্তব্যে উঠে আসে, “যদি প্রমাণিত হয়, দলগতভাবে জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কাজ করেছে, তবে আমি দায়িত্ব নিয়ে ক্ষমা চাইব। তবে সেটা মিথ্যা নয়, সত্য হতে হবে।”
ডা. শফিকুর রহমান তার বক্তব্যে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামী এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলোর ভূমিকা নিয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। তিনি স্বীকার করেন, সংগঠনের নেতারা ‘এক পাকিস্তানের’ পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন এবং বিভিন্ন জনসভায় পাকিস্তানের সমর্থনে ভাষণ দিয়েছেন। এর মধ্যে অধ্যাপক গোলাম আজমের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করেন তিনি, যিনি সে সময় জামায়াতের আমির ছিলেন।
তবে শফিকুর রহমান দাবি করেন, পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেওয়া মানে এই নয় যে তারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডে সরাসরি অংশ নিয়েছিল। তিনি বলেন, “তারা এক পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, কিন্তু তারা যুদ্ধের পক্ষে কোনো সাংগঠনিক রেজ্যুলুশন পাস করেনি। ব্যক্তিগতভাবে কেউ মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কাজ করে থাকলে সেটা তার ব্যক্তিগত দায়িত্ব, দলের না।”
সাক্ষাৎকারে শফিকুর রহমান বলেন, “ইতিহাস বিজয়ীর পক্ষে” কথাটি উল্লেখ করে দাবি করেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন মানুষ সরকারের সমর্থনে কাজ করেছে, কিন্তু দলীয়ভাবে জামায়াত কোনো যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। তিনি বলেন, “যদি কোনো দলীয় রেজ্যুলুশনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সংগঠন গঠন হয়ে থাকে এবং তার ডকুমেন্টেশন পাওয়া যায়, আমি সেই সত্য মেনে নেব।”
তিনি আরো বলেন, “রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসের মতো সংগঠনগুলো জামায়াতের ছায়াতলে গঠিত হয়েছিল বলে যে দাবি করা হয়, সেটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কাজ করেছে, তারা মূলত ব্যক্তিগতভাবে এসব কাজে যুক্ত ছিল, সংগঠনের নির্দেশনায় নয়।”
ডা. শফিকুর রহমান সাক্ষাৎকারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি অভিযোগ করেন যে, জামায়াতের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো ৪২ বছর পর আনীত হয়েছে এবং ট্রায়ালগুলো ‘ক্যাঙ্গারু ট্রায়াল’ হিসেবে পরিচালিত হয়েছে। তার ভাষায়, “যে লোকগুলোর বিরুদ্ধে এখন অভিযোগ আনা হলো, তাদের বিরুদ্ধে তখন (মুক্তিযুদ্ধের পর) কোনো থানায় অভিযোগ ছিল না। তাহলে ৪২ বছর পর কীভাবে এসব মামলা দায়ের হলো?”
তিনি দাবি করেন, মুক্তিযুদ্ধের পরপরই যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে ২৪ হাজার মামলা হয়েছিল এবং অনেকে তখন জেলে গিয়েছিল। কিন্তু এত বছর পর হঠাৎ করে জামায়াতের বিরুদ্ধে সব দোষ চাপানো ঠিক নয়। তিনি বলেন, “এটা কতটুকু ন্যায়সঙ্গত যে, জামায়াতের ঘাড়ে সবকিছু চাপিয়ে দেওয়া হলো? এটা কোনো নিরপেক্ষ বিচার হতে পারে না।”
জামায়াতের আমির সাক্ষাৎকারে বারবার উল্লেখ করেন যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো প্রমাণিত হতে হবে এবং প্রমাণের ভিত্তিতে সংগঠনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তিনি বলেন, “আমি কোনো গোঁজামিল বা মিথ্যার পক্ষে না। যদি দলগতভাবে জামায়াত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কিছু করে থাকে, তবে সন্দেহাতীতভাবে সেটা প্রমাণিত হতে হবে।”
ডা. শফিকুর রহমান উল্লেখ করেন যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল কিশোর এবং সেই সময়কার সব ঘটনাবলী সম্পর্কে তিনি প্রত্যক্ষভাবে জানেন না। তবে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, “যদি কোনো দলীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কাজ করা হয়ে থাকে, আমি তার জন্য ক্ষমা চাইতে প্রস্তুত। তবে সেটি মিথ্যার ভিত্তিতে নয়, সত্যের ভিত্তিতে হতে হবে।”
ডা. শফিকুর রহমান তার সাক্ষাৎকারে ভবিষ্যতের জন্য জামায়াতের পথনির্দেশ নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি উল্লেখ করেন, “জামায়াতে ইসলামী একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে দেশে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে কাজ করে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়ের যে ভুল বা অপরাধের অভিযোগ রয়েছে, সেগুলোকে মিথ্যার বশে চাপিয়ে দেওয়া হবে না।”
তার ভাষায়, “সত্য এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। জামায়াত যে অপরাধ করেনি, সেটাকে করতে বলা হবে না। তবে সত্য প্রকাশিত হলে, আমি জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে প্রস্তুত।”
শফিকুর রহমানের এই বক্তব্য জামায়াতে ইসলামী এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে একটি নতুন দৃষ্টিকোণ উপস্থাপন করেছে।