তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে চলমান রাজনৈতিক এবং আইনি বিতর্ক আবারও নতুন করে আলোচনায় এসেছে, যখন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার কোর্ট আগামী ২৪ অক্টোবর ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা দুটি রিভিউ আবেদনের শুনানির দিন ধার্য করেছে। আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি মো. রেজাউল হক এই শুনানির দিন নির্ধারণ করেন, যা দেশের রাজনৈতিক এবং সাংবিধানিক পরিস্থিতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় আনতে পারে।
২০১১ সালে বাংলাদেশের সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অকার্যকর ঘোষণা করা হয়। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নির্বাচনের সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিচালনার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের হাতে ফিরে আসে, যা আগে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরিচালিত হতো। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মূলত ১৯৯৬ সালের আন্দোলনের পর গণপ্রত্যাশার ভিত্তিতে প্রবর্তিত হয়, যেখানে নিরপেক্ষ নির্বাচনের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছিল।
তবে, ২০১১ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। এই রায়ের ভিত্তিতে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করা হয় এবং ভবিষ্যতে কোনো নির্বাচনে এই ব্যবস্থা কার্যকর থাকবে না বলে রায় দেওয়া হয়। এরপর থেকে এই ব্যবস্থা বাতিল নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক চলতে থাকে। বিশেষত, বিএনপি এবং তাদের সমর্থিত দলগুলো এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে আসছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ১৬ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টে একটি রিভিউ আবেদন করেন, যেখানে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পুনর্বিবেচনার দাবি জানানো হয়েছে। এর আগে, আগস্ট মাসে সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারও একটি রিভিউ আবেদন দায়ের করেন। এই দুটি আবেদনই আপিল বিভাগের আগের সিদ্ধান্তের পুনর্মূল্যায়ন চায় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনরায় প্রবর্তনের দাবি জানায়।
রিভিউ আবেদনে ১০টি মূল যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে, যা ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে। এডভোকেট জয়নুল আবেদীন, যিনি বিএনপির পক্ষে এই রিভিউ আবেদনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, বলেছেন, “সংক্ষিপ্ত আদেশ প্রকাশ করার পর পুরো রায় থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে, যা একটি বিচার বিভাগীয় প্রতারণার শামিল।” তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের অবসরের ১৮ মাস পর রায়টি প্রকাশ করা হয়েছিল, যা একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিষয় এবং এর ফলে রায়টি গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে।
এই রিভিউ আবেদনের প্রেক্ষাপটে বিচার বিভাগীয় প্রতারণার অভিযোগও তোলা হয়েছে। অভিযোগ করা হয়েছে যে, ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ে প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ের সাথে সংক্ষিপ্ত আদেশের মিল ছিল না, যা বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। রিভিউ আবেদনে এই বিষয়টি উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, সংবিধানের এই সংশোধনী বাতিলের প্রক্রিয়া এবং রায় প্রকাশে নানা অসঙ্গতি ছিল। ফলে, এই রায়টি পুনর্মূল্যায়নের জন্য যথাযথ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রতি জনসমর্থন বেশ উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে, বিশেষ করে বিএনপির মতো প্রধান বিরোধী দলগুলোর কাছে। তাদের দাবি হলো, এই ব্যবস্থা পুনর্বহাল করলে নির্বাচনে নিরপেক্ষতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। বর্তমান সরকার পরিচালিত নির্বাচনের সময় ক্ষমতাসীন দলকে প্রভাবমুক্ত রাখতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প নেই বলে তারা মনে করে।
এদিকে, বর্তমান শাসক দল আওয়ামী লীগ এই দাবির বিরোধিতা করে আসছে এবং তারা বিশ্বাস করে যে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সরকার পরিচালিত হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগের মতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তা নেই, বরং তা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে।
এই রিভিউ আবেদন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনর্বহালের দাবি নিয়ে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিএনপি এবং তাদের সমর্থিত দলগুলো এই ইস্যুতে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছে। তারা মনে করছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচনের ফলাফল গ্রহণযোগ্য হবে না এবং সেই নির্বাচন জনগণের প্রকৃত ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে পারবে না।
অন্যদিকে, বর্তমান সরকার এবং তাদের সমর্থিত দলগুলো মনে করছে যে, বিচার বিভাগ স্বাধীন এবং তাদের সিদ্ধান্তকে সম্মান করা উচিত। তারা বিশ্বাস করে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অকার্যকর এবং তা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক এবং সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পুনর্বিবেচনা আদালতের সামনে এখন এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক এবং সাংবিধানিক প্রশ্ন তৈরি করেছে। আপিল বিভাগের ২৪ অক্টোবরের শুনানি দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের দিকে একটি বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
জনমনে এই প্রশ্নও উঠেছে যে, বিচার বিভাগ কি রাজনৈতিক বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে একটি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারবে, নাকি এই বিতর্ক আরও জটিলতর হয়ে উঠবে। যা-ই হোক, ২৪ অক্টোবরের শুনানি এবং এর ফলাফল বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি নতুন অধ্যায় শুরু করবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।