ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকারের পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং ছাত্র আন্দোলনে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। অটোপাসের দাবিতে একদল শিক্ষার্থীর বিক্ষোভ-অবরোধের মুখে রোববার (২০ অক্টোবর) রাতে তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দেন। পদত্যাগের এই ঘোষণা শিক্ষাক্ষেত্রে বহুল আলোচিত হয়ে উঠেছে এবং এর প্রেক্ষিতে সম্ভাব্য পরিবর্তনগুলো ঘিরে নতুন আলোচনা শুরু হয়েছে।
অটোপাসের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষার স্থগিত হওয়া পরীক্ষা বাতিলের ঘটনায়। এই বছরের এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছিল গত ৩০ জুন। কিন্তু সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে চলা আন্দোলনের ফলে পরীক্ষার সময়সূচি স্থগিত করা হয়। ইতোমধ্যে ৭টি পরীক্ষা শেষ হলেও ৬টি বিষয়ের পরীক্ষা এবং ব্যবহারিক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। এরপর শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ দেখা দেয়, যা ধীরে ধীরে বিক্ষোভে রূপ নেয়।
গত ১৫ অক্টোবর যখন এইচএসসি-সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়, তখন দেখা যায় যে স্থগিত হওয়া বিষয়গুলোর মূল্যায়ন করা হয়েছে শিক্ষার্থীদের এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে। এই মূল্যায়ন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং তা আরও তীব্র আন্দোলনে রূপ নেয়। শিক্ষার্থীরা দাবি করতে থাকে যে, যেহেতু তাদের অনেক বিষয়ে পরীক্ষা হয়নি, তাই তাদেরকে অটোপাস দেওয়া হোক। এই দাবি পূরণ না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং রাস্তায় নেমে আসে।
রোববার দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড প্রাঙ্গণে ঢুকে একদল শিক্ষার্থী বিক্ষোভ ও অবরোধ করে। তারা দাবি করে, স্থগিত হওয়া পরীক্ষা বাতিল হওয়া সত্ত্বেও তাদের চূড়ান্ত মূল্যায়ন যথাযথ হয়নি এবং অটোপাস ছাড়া তাদের অন্যান্য মূল্যায়ন পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য নয়। বিক্ষোভের সময় তাদের ওপর হামলার অভিযোগও করে তারা, যার ফলে কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়।
অন্যদিকে বোর্ডের কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, কিছু শিক্ষার্থী ভবনের ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর করেছে এবং শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের কক্ষেও হামলা চালিয়েছে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী ও পুলিশ অবস্থান নেয় এবং শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করতে অনুরোধ করে। তবে শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়।
শিক্ষার্থীদের অব্যাহত বিক্ষোভের মুখে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেন, “আমি পদত্যাগ করলে যদি শিক্ষার্থীদের অটোপাসের দাবি পূরণ হয়, সেজন্য এ ঘোষণা দিলাম। আগামীকাল মন্ত্রণালয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেব।”
তার এই পদক্ষেপ শিক্ষাব্যবস্থার চলমান সংকটের মধ্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এটি শুধু শিক্ষা ব্যবস্থার উপরই নয়, বরং সরকারি প্রশাসনের প্রতিক্রিয়ার দিকেও দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। অনেকেই মনে করছেন যে, তার পদত্যাগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়া হতে পারে, যদিও এটি দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষাব্যবস্থার উপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি নিয়ে অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তারা স্পষ্ট করে জানিয়েছে যে, অটোপাস ছাড়া অন্য কোনো মূল্যায়ন পদ্ধতি তারা মানবে না। তাদের যুক্তি হলো, যেহেতু পরীক্ষা হয়নি এবং স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিল করা হয়েছে, তাই তাদের সঠিক মূল্যায়ন করার কোনো উপায় নেই। সুতরাং অটোপাসই তাদের একমাত্র দাবি।
অনেক শিক্ষার্থীই মনে করে যে, অটোপাস দিলে তারা সমানভাবে সুযোগ পাবেন এবং ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হবেন না। তাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
সরকার এই পরিস্থিতিতে এখনও সরাসরি কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেনি। তবে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে, অটোপাসের দাবি মেনে নিলে শিক্ষাক্ষেত্রে একটি নতুন নজির সৃষ্টি হবে যা ভবিষ্যতে আরও বিতর্কের সৃষ্টি করতে পারে। একই সঙ্গে এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মূল্যায়নের প্রতি অসন্তোষ বাড়তে পারে।
অনেকে আবার মনে করছেন যে, এই সমস্যার সমাধান না হলে শিক্ষাব্যবস্থা এবং ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে আরও জটিলতা দেখা দিতে পারে। সরকার এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হলে এই সংকট নিরসন সম্ভব, কিন্তু সেটা কতটা ফলপ্রসূ হবে তা সময়ই বলে দেবে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের পদত্যাগের ঘোষণা এবং অটোপাসের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি গভীর প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। একদিকে শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি এবং অন্যদিকে শিক্ষাক্ষেত্রে সুস্থ মূল্যায়ন পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা—এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা সরকারের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে।