সরকারি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও মেঘনা নদীতে মা ইলিশ ধরার দায়ে ৭ জন জেলেকে আটক করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ইলিশ সংরক্ষণ ও জাটকা রক্ষার উদ্দেশ্যে জারি করা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে প্রশাসন ব্যাপক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে অভিযানে ধরা পড়ে এ সাতজন জেলে। মৎস্য বিভাগ ও নৌ-পুলিশ যৌথভাবে এ অভিযান পরিচালনা করেছে, যা ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলাকালে অব্যাহত থাকবে।
মা ইলিশ রক্ষার লক্ষ্যে সরকার প্রতি বছর অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে থাকে। এ বছর ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রয়েছে, যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মা ইলিশকে ডিম ছাড়ার সময় নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা। নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা সময়ে দেশের বিভিন্ন নদীতে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় ইলিশের প্রধান প্রজনন কেন্দ্র লক্ষ্মীপুরের রামগতির আলেকজান্ডার থেকে চাঁদপুরের ষাটনল পর্যন্ত মেঘনা নদীর ১০০ কিলোমিটার এলাকাকে ইলিশের অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি অন্যান্য নদীতেও একই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে যাতে ইলিশ মাছের প্রজনন নির্বিঘ্ন হয়।
নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে নদীতে মাছ ধরার অপরাধ করলে দোষীদের সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো মাছ ধরার সরঞ্জাম জব্দ এবং অপরাধীদের আটক করে আইনের আওতায় আনতে সক্রিয় রয়েছে।
মেঘনা নদীতে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মাছ ধরার সময় আটক হওয়া ৭ জন জেলেকে তাৎক্ষণিক মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অভিযানের সময় তাদের কাছ থেকে মাছ ধরার জাল ও অন্যান্য সরঞ্জামও জব্দ করা হয়। মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে, নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে যাতে অন্যরা এই ধরনের অপরাধ থেকে বিরত থাকে।
ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ এবং এদেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিশ্বের মোট ইলিশের প্রায় ৭০ শতাংশ বাংলাদেশে উৎপন্ন হয়, যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে, ইলিশ রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হয় এবং দেশের জেলেরা জীবিকা নির্বাহ করেন।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অতিরিক্ত মাছ ধরা, বিশেষ করে জাটকা (ইলিশের ছোট বাচ্চা) শিকারের কারণে ইলিশের উৎপাদন অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। সরকার ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে ইলিশ সংরক্ষণে সচেতনতা সৃষ্টি ও বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। এর মধ্যে অন্যতম উদ্যোগ হচ্ছে প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা। এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে ইলিশ মাছের বংশবৃদ্ধি নিশ্চিত হয়, যা পরবর্তী বছরগুলোতে বেশি পরিমাণে ইলিশ উৎপাদনে সহায়ক হয়।
মৎস্য বিভাগ, নৌ-পুলিশ, কোস্টগার্ড এবং স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়ে গঠিত দল নিষেধাজ্ঞা কার্যকরে অভিযান পরিচালনা করছে। তারা নদীর বিভিন্ন স্থানে টহল দিয়ে জেলেদের মাছ ধরার সরঞ্জামাদি বাজেয়াপ্ত করছে এবং আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছে।
অভিযানের নেতৃত্বদানকারী মৎস্য বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, নদীতে সার্বক্ষণিক নজরদারি বাড়ানোর লক্ষ্যে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। মাছ ধরার জাল ও নৌকা জব্দ করে সেগুলো ধ্বংস করা হচ্ছে যাতে পুনরায় সেগুলো ব্যবহার করা না যায়। পাশাপাশি, জেলেদের সতর্ক করা হচ্ছে এবং তারা যাতে আইন মেনে চলে সে বিষয়েও প্রচার চালানো হচ্ছে।
ইলিশ সংরক্ষণে মৎস্য বিভাগ, এনজিও এবং বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সচেতনতা বৃদ্ধির বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিশেষ করে জেলেদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে এবং বিকল্প পেশায় নিয়োজিত করতে নানা ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে জেলেদের খাদ্য সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থাও করা হয়েছে যাতে তারা নদীতে মাছ ধরার প্রয়োজনে পড়ে না।
নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার ক্ষেত্রে প্রশাসনের সামনে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অনেক জেলে অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নদীতে মাছ ধরতে যান। এছাড়া কিছু অসাধু ব্যবসায়ী জেলেদের মাছ ধরতে উসকানি দেয়। ফলে প্রশাসনের কঠোর নজরদারির প্রয়োজন হয়।
তবে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে ইলিশ সংরক্ষণের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব। সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগের পাশাপাশি জেলেদের সচেতনতা বৃদ্ধি ও বিকল্প আয়ের উৎস নিশ্চিত করা হলে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে এবং ইলিশের উৎপাদন বাড়বে বলে আশা করা যাচ্ছে।
ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে এবং প্রজনন মৌসুমে ইলিশ রক্ষায় সরকারের এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও কিছু জেলে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নদীতে মাছ ধরার চেষ্টা করছেন, প্রশাসনের অভিযানের কারণে এ ধরনের কার্যক্রম দমিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে। ভবিষ্যতে ইলিশের উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতি ও মৎস্য খাতকে আরও সমৃদ্ধ করবে।