বাংলাদেশে সোনার দাম ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং এবারে এর ভরিতে দাম ১ লাখ ৪০ হাজার টাকার মাইলফলক অতিক্রম করেছে। দেশের বাজারে সোনার মূল্য বৃদ্ধির খবরটি সম্প্রতি বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) ঘোষণা করেছে। আগামী ২০ অক্টোবর থেকে ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম হবে ১ লাখ ৪০ হাজার ৬১ টাকা, যা গতদিন ছিল ১ লাখ ৩৭ হাজার ৪৪৮ টাকা। এই দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে প্রতি ভরিতে ২ হাজার ৬১৩ টাকা।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের মতে, সোনার এই মূল্যবৃদ্ধির মূল কারণ হচ্ছে স্থানীয় বাজারে তেজাবী সোনার মূল্যের উত্থান। এই সোনার দাম আন্তর্জাতিক বাজারের উপর নির্ভরশীল হলেও স্থানীয় চাহিদা, আমদানি খরচ, মুদ্রাস্ফীতি, ডলারের বিনিময় হার এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এর দাম উঠানামা করে। বৈশ্বিক মন্দা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সুদের হার বৃদ্ধির কারণে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। ফলে অন্যান্য মুদ্রার মান কমেছে, যার প্রভাব পড়েছে সোনার বাজারে। এছাড়াও, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংক্রান্ত অচলাবস্থা এই মূল্যবৃদ্ধির পিছনে বড় ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন সোনার মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়ার সময় বিভিন্ন ক্যারেটের সোনার নতুন মূল্যও জানিয়েছে। নতুন মূল্য তালিকা অনুযায়ী:
২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনা: ১,৪০,০৬১ টাকা
২১ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনা: ১,৩৩,৭০৪ টাকা
১৮ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনা: ১,১৪,৫৯৯ টাকা
সনাতন পদ্ধতির প্রতি ভরি সোনা: ৯৪,১১৭ টাকা
এদিকে, রুপার দাম অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। বর্তমানে ২২ ক্যারেটের রুপার দাম প্রতি ভরিতে ২ হাজার ১০০ টাকা, ২১ ক্যারেটের রুপার দাম ২ হাজার ৬ টাকা, ১৮ ক্যারেটের রুপার দাম ১ হাজার ৭১৫ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির রুপার দাম প্রতি ভরিতে ১ হাজার ২৮৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সোনার দাম বৃদ্ধির ফলে বাজারে এর প্রভাব ব্যাপক হতে পারে। প্রথমত, সাধারণ জনগণের জন্য সোনার গয়না ক্রয় আগের তুলনায় আরও বেশি ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে। বিশেষ করে বিয়ে, ধর্মীয় উৎসব এবং অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে সোনার গয়নার চাহিদা বেশি থাকে। সোনার এই মূল্যবৃদ্ধি নিম্ন এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য একটি বড় চাপ তৈরি করবে।
তাছাড়া, বিনিয়োগকারীদের জন্য সোনা ঐতিহ্যগতভাবে একটি নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম হিসাবে বিবেচিত হয়। সোনার মূল্য বৃদ্ধির ফলে বিনিয়োগকারীরা সোনায় আরও বেশি আগ্রহী হতে পারে। কারণ যখন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনিশ্চিত থাকে, তখন বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে সোনার দিকে ঝুঁকতে থাকে। এর ফলে সোনার বাজারে আরও বেশি বিনিয়োগ হতে পারে, যা এর দামকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সোনার দাম শুধুমাত্র গয়না বা বিনিয়োগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি দেশের মুদ্রা বিনিময় হারের ওপরও প্রভাব ফেলে। সোনার দাম বৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষ রুপির মতো কম মূল্যবান ধাতুর দিকে ঝুঁকতে পারে। এতে করে বাজারে রুপার চাহিদা বাড়তে পারে এবং এর দামও বাড়তে পারে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও সোনার দাম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে বাংলাদেশে সোনার আমদানি নির্ভরতা বেশি। যখন আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম বাড়ে, তখন দেশীয় বাজারে এর প্রভাব সরাসরি পড়ে। আমদানি করা সোনার উপর নির্ভর করে দেশীয় বাজারে সোনার দাম নির্ধারণ করা হয়, এবং সেই কারণে সোনার দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে আমদানি খরচও বেড়ে যায়।
বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতা চলতে থাকলে সোনার দাম আরও বাড়তে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সোনার বাজারে মুদ্রাস্ফীতি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর অর্থনৈতিক নীতিমালার পরিবর্তন এর মূল কারণ। এছাড়া, আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের মানের পতন হলে সোনার দাম আরও বাড়তে পারে। তবে, যদি আন্তর্জাতিক বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসে, তাহলে সোনার দামে কিছুটা স্থিতিশীলতা দেখা যেতে পারে।
সোনার দাম বৃদ্ধি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দেয়। সোনার উচ্চমূল্য শুধু জুয়েলারি ব্যবসার ওপর প্রভাব ফেলে না, এটি সাধারণ জনগণের জীবনে এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় গভীর প্রভাব ফেলে। বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে সোনার মূল্যবৃদ্ধি আরও বাড়তে পারে, এবং সাধারণ মানুষকে তাদের খরচ এবং বিনিয়োগের ব্যাপারে নতুনভাবে ভাবতে হবে।