ঢাকার সাভারের হেমায়েতপুরে নির্মাণাধীন একটি সেপটিক ট্যাংকে নেমে দুই নির্মাণশ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছে। শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) সকালে সাভার উপজেলার দক্ষিণ মেইটকা গ্রামে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। তবে মৃত ওই দুই শ্রমিকের নাম ও পরিচয় এখনো নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
স্থানীয়দের বরাত দিয়ে জানা গেছে, শুক্রবার সকালে এক নির্মাণশ্রমিক নির্মাণাধীন সেপটিক ট্যাংকের ভেতরে কাজ করার জন্য নামেন। তবে কিছুক্ষণ পর তার কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। তাকে উদ্ধার করতে গিয়ে অপর একজন শ্রমিকও সেপটিক ট্যাংকের ভেতরে প্রবেশ করেন। এর পর তাদের কেউই কোনো সাড়া না দেওয়ায় স্থানীয় লোকজন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে এবং তাৎক্ষণিকভাবে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে বিশেষ সরঞ্জাম ব্যবহার করে সেপটিক ট্যাংকের ভেতরে প্রবেশ করেন। সেখানে তারা দুই শ্রমিককে অচেতন অবস্থায় পান এবং দ্রুত তাদেরকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছানোর পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।
এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এবং মরদেহ দুটি হাসপাতাল থেকে উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করে। সাভার মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মুহাম্মদ জুয়েল মিয়া জানান, “মরদেহগুলো উদ্ধার করা হয়েছে এবং মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ধারণের জন্য ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।”
ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সেপটিক ট্যাংকের মতো বন্ধ জায়গাগুলোতে বিষাক্ত গ্যাস জমে থাকে, যা কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া প্রবেশ করলে মারাত্মক হতে পারে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ওই দুই শ্রমিক বিষাক্ত গ্যাসের কারণে শ্বাসকষ্টে ভুগে মারা গেছেন।
স্থানীয়রা জানান, নির্মাণাধীন এই সেপটিক ট্যাংকে কোনো নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না থাকায় এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। সেখানে কোনো সুরক্ষা সরঞ্জাম বা গ্যাস নির্গমন সিস্টেম ছিল না, যা মূলত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত জরুরি। স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, “এ ধরনের দুর্ঘটনা নতুন নয়। সেপটিক ট্যাংক নির্মাণের সময় অনেক ক্ষেত্রেই নিরাপত্তা অবহেলা করা হয়।”
এই ঘটনা সাভারসহ বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে নির্মাণশ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতার একটি বড় উদাহরণ। সেপটিক ট্যাংকের মতো বন্ধ জায়গায় কাজ করার সময় নিরাপত্তা সরঞ্জামের ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, অনেক নির্মাণকাজে এই সরঞ্জামের অভাব দেখা যায়। শ্রমিকরা প্রায়ই সুরক্ষা ছাড়াই ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় কাজ করতে বাধ্য হন, যার ফলে ঘটে যায় প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা।
কাজের সময় কোনো ধরনের নিরাপত্তা সরঞ্জাম যেমন মাস্ক, অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা বা গ্যাসের উপস্থিতি নির্ণয়ের যন্ত্র ব্যবহার করা হয় না। ফলে শ্রমিকরা গ্যাসের বিষক্রিয়া বা অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যুর সম্মুখীন হন। এই ধরনের দুর্ঘটনা শ্রমিকদের জীবনমান এবং তাদের কাজের নিরাপত্তা সম্পর্কে বড় প্রশ্ন তুলে ধরে।
এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা আমাদের সামনে এক বিরাট প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়: কেন এমন দুর্ঘটনা বারবার ঘটে, এবং কেন শ্রমিকদের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না? সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও কর্তৃপক্ষের উচিত নির্মাণকাজে শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিধানে আরও কঠোর নিয়ম এবং সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সেপটিক ট্যাংকের মতো স্থানগুলোতে কাজ করার সময় অবশ্যই সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা উচিত। তাছাড়া, যেকোনো নির্মাণকাজের সময় শ্রমিকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি নির্মাণস্থলে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।
প্রশিক্ষণ: শ্রমিকদের সঠিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে তারা জানেন কীভাবে সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার করতে হয় এবং কোন পরিস্থিতিতে প্রবেশ করতে হবে।
নিরাপত্তা সরঞ্জাম: নির্মাণস্থলে সর্বদা নিরাপত্তা সরঞ্জাম যেমন অক্সিজেন মাস্ক, গ্যাস নির্গমন ডিটেক্টর, এবং অন্যান্য সুরক্ষা ব্যবস্থা রাখতে হবে।
বিধিবিধান: সরকার এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে নির্মাণকাজের সময় নিরাপত্তা বিধান নিশ্চিত করতে কঠোর নিয়ম জারি করতে হবে এবং তা যথাযথভাবে কার্যকর করতে হবে।
সাভারের এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা আমাদের সমাজে শ্রমিকদের নিরাপত্তার প্রতি উদাসীনতার এক গভীর চিত্র তুলে ধরে। শ্রমিকরা যারা আমাদের সমাজের অন্যতম মূল স্তম্ভ, তাদের জীবনের মূল্য অবহেলা করে আমরা উন্নয়নকে সত্যিকার অর্থে এগিয়ে নিতে পারব না। নিরাপত্তার সঠিক ব্যবস্থা এবং শ্রমিকদের কল্যাণে সরকারের আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।