২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। বৃহস্পতিবার রাতে একটি আলোচনাসভায় তিনি এ কথা বলেন। নির্বাচনের সময়সূচি ও প্রক্রিয়া নিয়ে তার মন্তব্য সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সাম্প্রতিক বক্তব্যের পর প্রথম কোনো সরকার-ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টার সরাসরি প্রতিক্রিয়া।
ড. আসিফ নজরুলের বক্তব্যে আসন্ন নির্বাচন ছাড়াও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং শেখ হাসিনার বিচার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসে, যা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে।
আসন্ন নির্বাচন নিয়ে ড. আসিফ নজরুল বলেন, “২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন দেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে।” তবে তিনি সরাসরি সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখ ঘোষণা করেননি। এ ছাড়া তিনি জানান, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমের প্রতি জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য খুব শিগগিরই একটি সার্চ কমিটি গঠন করা হবে। এই কমিটি নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের নির্বাচন ও নিয়োগের প্রক্রিয়ায় দায়িত্ব পালন করবে।
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সম্প্রতি একটি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে এবং কিছুদিনের মধ্যে এর সময়সূচি চূড়ান্ত হবে। ড. আসিফ নজরুলের বক্তব্য সেই ইঙ্গিতকে আরও দৃঢ় করে তুলেছে এবং মনে করা হচ্ছে যে সরকার যথাসময়ে একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়া শুরু করতে আগ্রহী।
আলোচনায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি প্রসঙ্গে জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে ড. আসিফ নজরুল বলেন, “তরকারির এত দাম বেড়ে গেছে যে বিক্রি কমে গেছে।” তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, বন্যার কারণে ডিমের সরবরাহও কমে গেছে, যা বাজারে সংকট তৈরি করেছে। তিনি পূর্ববর্তী সরকারের সময় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ করেন এবং আশ্বাস দেন যে বর্তমান পরিস্থিতি কিছু দিনের মধ্যে উন্নতি করবে।
এ বক্তব্য দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকটের প্রতিফলন। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরেই। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলেছে। তবে ড. আসিফ নজরুল জনগণকে আশ্বস্ত করেন যে, পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাচ্ছে এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ শিগগিরই ফলপ্রসূ হবে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সমালোচনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি প্রধান ইস্যু হয়ে উঠেছে। এই আইনের আওতায় সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী এবং সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার অভিযোগ ওঠার পর থেকেই এটি নিয়ে বিতর্ক চলছে। ড. আসিফ নজরুল বলেন, “ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট আমরা পুরোটাই বাতিল করার প্রক্রিয়ায় আছি। মানুষ এই নামগুলোই শুনতে পারে না।”
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সমালোচনা চলছিল। বিশেষ করে এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হ্রাস করছে বলে অনেকেই অভিযোগ করেছেন। ড. আসিফ নজরুলের এই বক্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, সরকার এই আইন পুরোপুরি বাতিল করতে পারে এবং এর মাধ্যমে বাকস্বাধীনতা আরও সুসংহত করা হবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাংবাদিকদের বিচার নিয়ে ড. আসিফ নজরুল বলেন, “কোনো সাংবাদিকের বিচার হবে এমন কথা আগে কখনো বলিনি।” তার এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, সরকারের লক্ষ্য সাংবাদিকদের হয়রানি করা নয়। এর মাধ্যমে তিনি সাংবাদিকদের প্রতি সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিত দিয়েছেন।
শেখ হাসিনার বিচার প্রসঙ্গে ড. আসিফ নজরুল বলেন, “এই চুক্তি ভারত মানলে তাদের শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত।” তিনি বন্দি বিনিময় চুক্তির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন যে, চুক্তি সঠিকভাবে মানলে ভারত শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে।
শেখ হাসিনার বিচার ও বন্দি বিনিময় চুক্তি নিয়ে ড. আসিফ নজরুলের এই বক্তব্য রাজনৈতিক মহলে নতুন আলোচনার সূত্রপাত করেছে। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেত্রী এবং তার বিচার সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হওয়া দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারে।
ড. আসিফ নজরুলের এই বক্তব্য এমন সময়ে এসেছে, যখন দেশের রাজনীতি বেশ উত্তপ্ত। একদিকে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে বিরোধীদলগুলো আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, অন্যদিকে সরকারের নানা পদক্ষেপ ও বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনা তৈরি করছে। বিশেষ করে শেখ হাসিনার বিচার ও বন্দি বিনিময় চুক্তি নিয়ে আলোচনা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সরকারের অবস্থান দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিবেশে প্রভাব ফেলতে পারে।
ড. আসিফ নজরুলের বক্তব্য শুধু আসন্ন নির্বাচনের দিকনির্দেশনা দেয়নি, বরং দেশের বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইস্যু নিয়েও জনগণকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছে। তার বক্তব্যের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সরকার যে সংস্কারের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ড. আসিফ নজরুলের বক্তব্যে উঠে আসা বিভিন্ন ইস্যু যেমন নির্বাচন, দ্রব্যমূল্য, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং শেখ হাসিনার বিচার নিয়ে করা মন্তব্য বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষ করে ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ইঙ্গিত, জনগণের মনে কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছে। তবে রাজনৈতিক অঙ্গনে এসব ইস্যু নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক আরও জোরালো হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
ড. আসিফ নজরুলের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যতে সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নেয় এবং এসব ইস্যু নিয়ে বিরোধীদলগুলোর প্রতিক্রিয়া কেমন হয়, তা দেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।