দেশে কাঁচা মরিচের সংকট যখন প্রকট, তখন ভারতে থেকে বড় চালানে আমদানি করা হচ্ছে এই মৌসুমি সবজি। যশোরের শার্শা উপজেলার বেনাপোল দিয়ে গত দুই দিনে ভারত থেকে এসেছে প্রায় ৬০০ টন কাঁচা মরিচ। বাজারে মরিচের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং সরবরাহ নিশ্চিত করতে এই বিশাল চালানটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) বিকাল ৫টা পর্যন্ত ভারত থেকে মোট ৫৯৩ টন কাঁচা মরিচ এসেছে, যার মধ্যে সোমবারই আসে ৫৮১ টন ৯৭০ কেজি এবং মঙ্গলবার ১০ টন ৯৫৬ কেজি।
কাঁচা মরিচের দাম সাধারণত বর্ষাকাল এবং বিশেষ করে ধর্মীয় উৎসবগুলোর সময় বৃদ্ধি পায়। এই সময়ে মরিচের সংকট এবং উৎপাদন কমে যাওয়ায় দাম বেড়ে যায়। দেশীয় বাজারে ক্রমাগত দাম বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে, কাঁচা মরিচের এই আমদানি বাজার স্থিতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ভারতের দুর্গাপূজার কারণে বেনাপোল এবং পেট্রাপোল বন্দরগুলো পাঁচ দিন বন্ধ ছিল। এতে ভারত থেকে মরিচসহ অন্যান্য পণ্য আসতে বিলম্ব হয়, যা দেশের বাজারে সরবরাহ সংকট সৃষ্টি করে। তবে সোমবার বন্দরগুলো পুনরায় চালু হওয়ার সাথে সাথে একদিনেই ৫০টি ট্রাকের মাধ্যমে ভারত থেকে ৫৮১ টন ৯৭০ কেজি কাঁচা মরিচ আমদানি হয়। মঙ্গলবারও আরও ১০ টন ৯৫৬ কেজি মরিচ আমদানি হয়, যা কাস্টমসের প্রক্রিয়া শেষ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়েছে।
বেনাপোল কাস্টমস থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, মোট ২৮ জন আমদানিকারক এই মরিচ আমদানি করেছেন। ভারত থেকে প্রতিটি টনের আমদানি মূল্য ধরা হয়েছে ৬০ হাজার টাকা। তার ওপর আমদানি শুল্ক ৩৬ হাজার টাকা হিসেবে কেজিপ্রতি আমদানি মূল্য দাঁড়িয়েছে ৯৬ টাকা। এর ফলে বাজারে কাঁচা মরিচের খুচরা দাম ৯৬ টাকায় নামবে বলে আশা করা হচ্ছে। বেনাপোল চেকপোস্ট কার্গো শাখার রাজস্ব কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান জানান, শুল্কসহ সব ধরনের করাদি পরিশোধ করে ইতোমধ্যে ট্রাকগুলো বন্দর এলাকা ত্যাগ করেছে।
দেশের কাঁচা মরিচের বাজারে দাম হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল। বিশেষ করে খাদ্যপ্রিয় বাঙালির রান্নার অন্যতম প্রধান উপকরণ কাঁচা মরিচের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার আমদানির ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়েছে। অভ্যন্তরীণ বাজারে মরিচের সংকটের কারণে কিছু স্থানে মরিচের দাম কেজি প্রতি ২০০ টাকার উপরে উঠেছিল। এ পরিস্থিতিতে ভারত থেকে মরিচ আমদানি করে বাজারের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
আমদানির পরিপ্রেক্ষিতে কাঁচা মরিচের দাম কিছুটা স্থিতিশীল হবে বলে বাজার বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। তবে এর প্রভাব কতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে তা নির্ভর করবে দেশীয় উৎপাদন এবং ভবিষ্যতে আমদানির ধারাবাহিকতার ওপর। অনেক ব্যবসায়ী আশা করছেন, আমদানি করা মরিচ বাজারে এসে পৌঁছানোর পর দাম ধীরে ধীরে আরও কমতে পারে।
কাঁচা মরিচের দাম বৃদ্ধির পিছনে প্রধান কারণ হলো জলবায়ুগত সমস্যা ও কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়া। মরিচ চাষে বর্ষাকালের অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত এবং অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এছাড়া, কৃষকরা মরিচ চাষে উদ্বুদ্ধ না হওয়ায় দেশীয় উৎপাদন কমে গেছে। ফলস্বরূপ, চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে একটি বড় ফাঁক তৈরি হয়েছে। এই ফাঁক পূরণে সরকার আমদানির উপর নির্ভর করছে।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। বিদেশ থেকে আমদানি সাময়িকভাবে চাহিদা মেটাতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি স্থায়ী সমাধান নয়। স্থানীয় চাষিরা যাতে আরও বেশি মরিচ উৎপাদনে আগ্রহী হন, সেই লক্ষ্যে সরকারের উচিত সহায়ক নীতি গ্রহণ করা।
বেনাপোল বন্দর দেশের অন্যতম প্রধান স্থলবন্দর, যার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি ও রপ্তানি হয়ে থাকে। বিশেষ করে ভারত থেকে শাকসবজি, ফলমূল এবং অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য আমদানির জন্য বেনাপোল একটি গুরুত্বপূর্ণ রুট। বন্দরের কার্যক্রম দুর্গাপূজার ছুটির পর পুনরায় চালু হওয়ার পর থেকে পণ্য প্রবাহ বাড়তে শুরু করেছে। বেনাপোল বন্দরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কাঁচা মরিচসহ অন্যান্য পণ্য শুল্ককরাদি পরিশোধের পর দ্রুত খালাস করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়েছে।
কাস্টমস কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে আমদানিকারকদের সহযোগিতা করে দ্রুত পণ্য খালাস করা। ফলে পণ্য সরবরাহে বিলম্ব হয় না এবং বাজারে দ্রব্যের সংকটও কমে আসে।” তিনি আরও জানান, এই ধরনের বড় চালানগুলোকে দ্রুত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে যেন বাজারে সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়, তা নিশ্চিত করতে বন্দর কর্তৃপক্ষ কাজ করে যাচ্ছে।
ভারত থেকে মরিচ আমদানির জন্য দেশের ২৮ জন আমদানিকারক কাজ করছেন। তারা এই আমদানির মাধ্যমে দেশের বাজারে মরিচের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং সরবরাহ স্বাভাবিক করতে সহায়তা করছেন। আমদানিকারকদের মধ্যে অনেকেই জানিয়েছেন, দেশের বাজারে চাহিদা মেটানোর জন্য তারা আরও বেশি চালান আনার পরিকল্পনা করছেন। এতে কাঁচা মরিচের দাম আরও স্থিতিশীল হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে কাঁচা মরিচের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভারত থেকে মরিচ আমদানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। দেশের বাজারে মরিচের দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছিল, তা এই আমদানি কিছুটা হলেও প্রশমিত করবে। তবে, ভবিষ্যতে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানোর দিকে আরও মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।