১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবরের রাতটি ঢাকার জগন্নাথ হলের শিক্ষার্থীদের কাছে এক ভয়াবহ স্মৃতির দিন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের পরিষদ ভবন হিসেবে পরিচিত, একশ বছরেরও বেশি পুরোনো একটি অডিটোরিয়ামের ছাদ ধসে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। ওই সময় এটি জগন্নাথ হলের টেলিভিশন কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। ঘটনার সময় বাংলাদেশ টেলিভিশনের জনপ্রিয় নাটক ‘শুকতারা’ দেখতে ভেতরে অবস্থান করছিলেন প্রায় ২০০ থেকে ৪০০ শিক্ষার্থী। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে সেই রাতের দুর্যোগ হয়ে ওঠে শতাধিক মানুষের জন্য এক প্রাণঘাতী রাত।
ঘটনার সময় টিভি রুমের ভেতরে ছিলেন স্বপন কুমার দে, যিনি বর্তমানে জগন্নাথ হল কর্মচারী কল্যাণ সমিতির সভাপতি। স্বপন কুমারের বয়স তখন কিশোরকালেই ছিল। তার বাবা হলের বাগানের মালী হিসেবে কাজ করতেন, যার ফলে হল এলাকার মধ্যেই তাদের বসবাস ছিল। স্বপন কুমার দে জানান, সেদিন বিকেল থেকেই ঢাকায় তুমুল ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল। দুর্ঘটনার সময়ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি চলছিল। তিনি বলেন, সেদিন রাত সাড়ে আটটার দিকে টিভি কক্ষে গিয়ে বসেছিলেন নাটক দেখতে। নাটক শুরুর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দুর্ঘটনাটি ঘটে।
টিভি রুমের ভেতরে প্রায় ২০০ জন মানুষ ছিল বলে ধারণা করেন স্বপন কুমার। তবে পত্রিকাগুলোর মতে, সেই সংখ্যাটা ছিল প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ জনের মতো। ছাদের নিচে সারিবদ্ধভাবে রাখা চেয়ারের সামনে একটি কাঠের চৌকির ওপর বসে নাটক দেখছিলেন স্বপন কুমার। নাটক চলাকালীন হঠাৎ করে ছাদ থেকে বালির গুঁড়া ঝরে পড়তে শুরু করে। এরপর প্রচণ্ড শব্দে ছাদ ধসে পড়ে। ভাগ্যক্রমে দুই শিক্ষার্থী তাকে দুই দিক থেকে ধরে টেলিভিশনের পেছনের দিকে সরিয়ে নিয়ে যায়। চৌকিতে বসা অনেক শিক্ষার্থী শেষ মুহূর্তে নিরাপদ আশ্রয় নিতে পেরেছিল, কিন্তু অনেকেই ছাদের নিচে চাপা পড়ে যায়।
স্বপন কুমার দে আরও বলেন, ধসের পরপরই তিনি চারদিকে আর্তনাদ শুনতে পান—’বাবারে, মাগো, বাঁচাও’। হতভম্ব হয়ে ঘটনাস্থল থেকে ছুটে বের হয়ে আসেন। বাইরে গিয়ে মানুষকে জানান, ছাদ ধসে পড়েছে। ফিরে আসার পরও অনেকক্ষণ অপ্রকৃতিস্থ ছিলেন তিনি। তিনি বলেন, “তখন আমার বয়স কম ছিল, এমন রক্ত, মৃত্যু আর আর্তনাদের মধ্যে মানসিকভাবে স্থির থাকতে পারিনি।”
দুর্ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে ৩৪ জনের মৃত্যু ঘটে, এবং পরবর্তী সময়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ৫ জনের মৃত্যু হয়। তবে আহতদের সঠিক সংখ্যা কখনোই নির্ধারণ করা যায়নি। পত্রিকাগুলোর প্রতিবেদনে শতাধিক আহত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত এক তদন্তে জানানো হয়, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে ভবনটি ধসে পড়ে। ভবনটি ছিল একশ বছরেরও বেশি পুরোনো এবং দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হওয়ায় এটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। বৃষ্টির কারণে সেই দুর্বল ভবনের ছাদ ধসে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে।
ভবন ধসের পর পুরো অডিটোরিয়াম ভবনটি ভেঙে ফেলা হয়। পরবর্তীতে একই স্থানে নতুন একটি ছাত্রাবাস নির্মাণ করা হয়, যার নাম দেওয়া হয় ‘অক্টোবর স্মৃতি ভবন’। এটি সেই শিক্ষার্থীদের স্মৃতিতে গড়ে তোলা হয়, যারা ওই রাতে প্রাণ হারিয়েছিল। সেই থেকে প্রতি বছর ১৫ অক্টোবর তারিখটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শোক দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এই দিনটিতে শিক্ষার্থীরা এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সমবেত হন সেই মর্মান্তিক ঘটনার স্মরণে এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শোক দিবস শুধু ওই দিনের প্রাণহানির স্মৃতি নয়, এটি একটি বার্তা বহন করে যে পুরোনো অবকাঠামোগত সমস্যাগুলো অবহেলা করা উচিত নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং ভবিষ্যতের প্রজন্মকে এমন মর্মান্তিক ঘটনার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সজাগ থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।