ফেসবুকের মাধ্যমে পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে ওঠা আজকাল খুবই সাধারণ ঘটনা। তবে ভারতের মুর্শিদাবাদের ডোমকলে ঘটে যাওয়া এক ঘটনার পরিণতি ছিল চমকপ্রদ। স্ত্রীর সন্দেহের বশবর্তী হয়ে তার স্বামীকে ফাঁদে ফেলার জন্য যে অভিনব পরিকল্পনা করেছিলেন, তার পরিণতি শেষ পর্যন্ত রাস্তায় মারধর ও থানায় গিয়ে শেষ হয়।
ডোমকলের এই ঘটনার মূল নায়ক বিক্রম মণ্ডল (৪০), যিনি পেশায় একজন মাছ ব্যবসায়ী এবং দুই সন্তানের জনক। স্ত্রী অনেক দিন ধরেই তার স্বামীর উপর পরকীয়ার অভিযোগ আনছিলেন। কিন্তু এই অভিযোগকে বিক্রম সোজাসুজি অস্বীকার করতেন। সন্দেহের বশবর্তী হয়ে বিক্রমের স্ত্রী ফেসবুকে একটি ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে স্বামীকে ফাঁদে ফেলার পরিকল্পনা করেন, যা পরিণত হয় এক অবিশ্বাস্য নাটকে।
বিক্রমের স্ত্রী ফেসবুকে একটি নতুন মেয়ে সেজে তার স্বামীকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠান। তার আইডি দেখে অপেক্ষা না করেই বিক্রম সেই রিকোয়েস্ট গ্রহণ করেন এবং শুরু হয় চ্যাটিং। প্রতিদিনের চ্যাটিং ধীরে ধীরে রোমাঞ্চে পরিণত হয়, এবং বিক্রম তার নতুন প্রেমিকার সঙ্গে সম্পর্ককে আরো গভীর করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন।
চ্যাটে তিনি তার বর্তমান জীবন, কাজ, এবং ঘরের কথাগুলো ধীরে ধীরে শেয়ার করেন। বিক্রম জানতেন না যে তার কথোপকথনের অপর প্রান্তে আসলে তার স্ত্রীই রয়েছেন। অপর দিকে, তার স্ত্রী বেশ কৌশলে বিক্রমকে প্রেমের জালে আটকে ফেলে। এক পর্যায়ে বিক্রম তার নতুন প্রেমিকাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন।
বিক্রমের স্ত্রীও যেন পরিকল্পনা অনুযায়ী অগ্রসর হতে থাকেন। তিনি বিক্রমের সঙ্গে দেখা করার কথা বলেন, তবে শর্ত দেন যে দেখা করতে হলে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে হবে। বিক্রম একটুও সময় নষ্ট না করে এই শর্ত মেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতে থাকেন যে তার নতুন প্রেমিকা হয়তো তার জীবনে নতুন একটি সুযোগ হয়ে আসবে।
বিক্রম তার নতুন প্রেমিকার সাথে দেখা করার জন্য দিনক্ষণ নির্ধারণ করে। বৃহস্পতিবার দুপুরে তিনি ব্যাগ গুছিয়ে ডোমকল বাসস্ট্যান্ডে যান, যেখানে তার নতুন প্রেমিকা তার জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে বিক্রম যা দেখলেন, তাতে তিনি বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যান।
বাসস্ট্যান্ডে বসে থাকা মেয়েটি আর কেউ নন, স্বয়ং তার স্ত্রী। বিক্রম অবাক হয়ে দেখলেন যে যার সাথে তিনি এতদিন ধরে ফেসবুকে প্রেম করছেন, তিনি আসলে তারই স্ত্রী। এক মুহূর্তের জন্য তার মাথা কাজ করতে চাচ্ছিল না, এবং তিনি বুঝতে পারলেন যে পুরো সময়টি ধরে তিনি একটি জালে আটকা পড়েছিলেন।
বিক্রমের এমন অবস্থা দেখে তার স্ত্রী আর সময় নষ্ট করেননি। তিনি তার ভাইদের ডাকেন, যারা বিক্রমকে ধরে বেধড়ক মারধর শুরু করেন। ঘটনাস্থলে তখন উপস্থিত অনেক লোক এই অপমানজনক দৃশ্য দেখছিলেন, কিন্তু কেউই তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি।
ঘটনা এতোটাই মারাত্মক আকার ধারণ করে যে পুলিশ এসে বিক্রমকে উদ্ধার করতে বাধ্য হয়। পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং বিক্রমকে নিরাপত্তার জন্য থানায় নিয়ে যায়। স্ত্রীর অভিযোগ ছিল যে, বিক্রম একাধিক নারীর সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত এবং এর প্রমাণ হিসেবে তার ফেসবুকের কথোপকথন তুলে ধরেন।
পুলিশ বিক্রমকে থানায় নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং বিষয়টি তদন্তের জন্য নথিভুক্ত করে। তবে পারিবারিক এই ঘটনাটি পরবর্তীতে কিভাবে নিষ্পত্তি হয়, তা তখনকার মতো অজানা থেকে যায়। স্থানীয় লোকজনের মতে, এ ঘটনার পর থেকে বিক্রম ও তার স্ত্রী দুজনেই নিজেদের সম্পর্কে কিছুটা দূরত্ব তৈরি করেছেন।
এই ঘটনার পর অনেকেই ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমের অপব্যবহারের প্রতি আঙ্গুল তোলেন। সহজলভ্য যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ব্যবহার সঠিকভাবে না হলে কিভাবে তা সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, ডোমকলের এই ঘটনা তার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে উঠেছে। বিক্রম ও তার স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে যে অবিশ্বাস ও সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছিল, তা হয়তো যথাযথ যোগাযোগ ও পারস্পরিক বিশ্বাসের মাধ্যমে সমাধান করা যেত।
তবে প্রযুক্তির হাত ধরে যখন একে অপরের প্রতি সন্দেহ দানা বাঁধে, তখন তা সম্পর্ককে ধ্বংস করে দেয়ার পথে নিয়ে যেতে পারে। ডোমকলের এই ঘটনার মাধ্যমে একটি বড় শিক্ষা পাওয়া যায়, যা হলো প্রযুক্তি ব্যবহার করার পাশাপাশি পারিবারিক সম্পর্কগুলোকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করানো প্রয়োজন। সন্দেহ বা অবিশ্বাসের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সম্পর্ক কখনই স্থায়ী বা সফল হতে পারে না।
বিক্রমের এই ঘটনা শুধু তার ব্যক্তিগত জীবনের জন্য নয়, পুরো সমাজের জন্য একটি সতর্কতা। আমরা প্রযুক্তিকে কিভাবে ব্যবহার করছি, তা নির্ভর করে আমাদের নৈতিকতা ও আদর্শের উপর। একইসাথে, পারিবারিক সম্পর্কগুলোকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন পারস্পরিক বিশ্বাস ও যোগাযোগের সঠিক ব্যবহার।
এই ঘটনার পরে স্থানীয়ভাবে অনেক ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কিছু মানুষ স্ত্রীর কাজের প্রশংসা করে বলেছেন যে, তিনি তার স্বামীর অপকর্ম ধরে ফেলার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছেন। অন্যদিকে, অনেকে মনে করেন যে স্ত্রীর উচিত ছিল তার স্বামীর সাথে সরাসরি কথা বলে সম্পর্কের সমস্যাগুলো সমাধান করা।
তবে যে যেভাবেই দেখুক, ডোমকলের এই ঘটনা একটি বিষয় স্পষ্ট করে দিয়েছে— সম্পর্কের মধ্যে বিশ্বাস ও সততার অভাব থাকলে, তা যেকোনো সময় ধ্বংসের মুখে পড়তে পারে।