ঢাকা, ৯ অক্টোবর ২০২৪ – রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় দুই বাসের ভয়ানক প্রতিযোগিতার মধ্যে চাপা পড়ে তাসলিম জাহান আইরিন (২৪) নামের এক নারীর মৃত্যু সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে আবারও প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। বুধবার সকালে প্রগতি সরণিতে এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, তাসলিম জাহান নেক্সট ভেনচার নামে একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ সম্পন্ন করেন। তিনি প্রতিদিনের মতো কর্মস্থলে যাওয়ার পথে প্রগতি সরণি এলাকায় রাস্তা পার হচ্ছিলেন। সে সময় আকাশ পরিবহনের দুটি বাস প্রতিযোগিতা করতে থাকে। এ সময় তাসলিম দুই বাসের মাঝে পড়ে যান এবং এক বাস তাকে টেনেহিঁচড়ে সামনের দিকে নিয়ে যায়। দুর্ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
তাসলিমের সহকর্মী শেখ রফিক আহমেদ বলেন, “তাসলিম অফিসে আসার সময় বাসের চাপায় পড়ে যান। দুটি বাসের চালকরা কোনো ধরনের সাবধানতা না নিয়ে প্রতিযোগিতা করছিল, যা একেবারেই দায়িত্বজ্ঞানহীন।” দুর্ঘটনার খবর জানার পর তাসলিমের সহকর্মীরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সড়ক অবরোধ করেন। তারা বিক্ষোভ শুরু করলে বাড্ডা থেকে মালিবাগের দিকে যাওয়ার সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়।
বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, আকাশ পরিবহনের বাস চাপা দেয়ার ফলে তাসলিম জাহানের মৃত্যু হয়। বাসটি জব্দ করা হলেও চালক ও হেলপার পালিয়ে গেছেন। তারা এখনও পলাতক রয়েছে।
ওসি আরও জানান, “মরদেহটি ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। আমরা চালক ও হেলপারকে আটক করতে অভিযান চালাচ্ছি।”
রাজধানীর ব্যস্ত সড়কগুলোতে বাসের প্রতিযোগিতা নতুন কিছু নয়। প্রায়ই বিভিন্ন দুর্ঘটনায় প্রাণহানির খবর শোনা যায়, যা শহরের জননিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কঠোর নিয়ম থাকা সত্ত্বেও বাসচালকদের অবহেলার কারণে বারবার এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে। শুধু চালকদের নয়, পরিবহন মালিকদেরও দায়বদ্ধতার আওতায় আনা প্রয়োজন বলে মত দিয়েছেন বিভিন্ন বিশেষজ্ঞরা।
সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে নিয়মিত প্রতিবাদ করেও কার্যকরী কোনো সমাধান দেখা যায়নি। তাসলিমের মৃত্যু শুধুমাত্র তার পরিবারের জন্যই নয়, বরং সারা দেশের মানুষকে আবারও গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে।
এ ধরনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা বারবার ঘটলেও সড়ক নিরাপত্তার উন্নয়নে তেমন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ তুলছেন সাধারণ জনগণ। ঢাকা শহরের সড়কগুলোতে যানবাহনের অতিরিক্ত গতি, অব্যবস্থাপনা এবং আইন না মানার প্রবণতা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সড়ক নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন সংগঠন ও সাধারণ মানুষ বারবার আন্দোলন করলেও, যথাযথ প্রতিকার না পাওয়ার হতাশা দেখা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিরাপদ সড়কের জন্য প্রয়োজন কঠোর আইন প্রয়োগ, বাসচালকদের প্রশিক্ষণ, এবং প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসার শিক্ষা।
তাসলিম জাহানের মৃত্যু আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে এখনই কঠোর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। এর আগে, ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করলেও তা স্থায়ী সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি।
দুর্ঘটনার পর পরই সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভের ঘটনাগুলো সাময়িকভাবে মিডিয়াতে আলোচিত হলেও, দীর্ঘমেয়াদে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধ করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। এ জন্য জনসচেতনতা বাড়ানো এবং পরিবহন সেক্টরের পুনর্গঠন প্রয়োজন।
বিআরটিএ এবং পুলিশের পাশাপাশি নাগরিকদেরও সড়কে সচেতন থাকতে হবে। আইন মানার প্রবণতা বাড়াতে হবে এবং সরকারকে এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে যাতে সড়কে প্রতিযোগিতা ও গতি নিয়ন্ত্রণে থাকে।
তাসলিম জাহানের এই মর্মান্তিক মৃত্যু কেবল একটি ব্যক্তি বা পরিবারের ক্ষতি নয়, বরং এটি সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার ত্রুটিগুলোর একটি প্রতিফলন। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজন কঠোর আইন প্রয়োগ, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির। যদি এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়, তবে এমন মর্মান্তিক ঘটনা বারবার ঘটতে থাকবে, যা আমাদের সকলের জন্যই অশনিসংকেত।
এখন সময় এসেছে নিরাপদ সড়কের দাবিতে একযোগে কাজ করার।