কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের লেক কিভুতে গত বৃহস্পতিবার ঘটে যাওয়া নৌকা ডুবির ঘটনায় ৭৮ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় উদ্ধার হয়েছে ৫৮ জন, তবে এখনও বেশ কয়েকজন নিখোঁজ রয়েছেন। দক্ষিণ কিভু রাজ্যের গভর্নর জেন জ্যাকিউস পুরিসি জানান, নৌকাটিতে মোট ২৭৮ জন যাত্রী ছিল। অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই ও রাজনৈতিক সহিংসতার জেরে স্থলপথের বিকল্প হিসেবে নৌযানকে বেছে নেওয়া মানুষের জন্য লেক কিভু হয়ে উঠেছে মৃত্যুর ফাঁদ।
নৌকাটি মিনোভা শহর থেকে রওনা হয়েছিল এবং গন্তব্য ছিল গোমা শহর, যা কিভু লেকের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত। গোমার কাছাকাছি পৌঁছানোর মাত্র ১০০ মিটার দূরে নৌকাটি ডুবে যায়। অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই এবং নৌকার অপ্রতুল নিরাপত্তা ব্যবস্থা এমন দুর্ঘটনার মূল কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। কঙ্গোর এই অঞ্চলটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী এম-২৩ এবং সরকারের মধ্যে চলমান সংঘর্ষে বিধ্বস্ত। ফলে স্থানীয় বাসিন্দারা নিরাপত্তার খোঁজে নৌপথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন, যা আরও বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করছে।
কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের লেক কিভু দীর্ঘদিন ধরেই একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন পথ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তবে নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাবে এই লেকটি বরাবরই ঝুঁকিপূর্ণ। এই দুর্ঘটনাটি কঙ্গোর চলমান সংকটের একটি ভিন্নমুখী প্রতিফলন, যেখানে মানুষ নৌকায় করে অজানা পরিণতির দিকে পাড়ি দিচ্ছে, তাদের কাছে স্থলপথের থেকে নৌপথকেই নিরাপদ মনে হচ্ছে।
কঙ্গোর এই অঞ্চলের রাজনৈতিক সহিংসতা, বিশেষ করে বিদ্রোহী গোষ্ঠী এম-২৩ এর সঙ্গে সরকারের সংঘর্ষ, এই পরিস্থিতির জন্য প্রধানত দায়ী। কঙ্গোর পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে উত্তর ও দক্ষিণ কিভু, কয়েক দশক ধরে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর তাণ্ডবে বিপর্যস্ত। এম-২৩ গোষ্ঠীটি কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে তীব্র সহিংসতা চালিয়ে যাচ্ছে, যার ফলে হাজার হাজার মানুষ তাদের গ্রাম ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। ফলে মানুষজন নিরাপত্তার আশায় ঝুঁকিপূর্ণ পথে পাড়ি দিচ্ছে।
রাস্তা বন্ধ থাকার কারণে স্থানীয় জনগণের নৌপথকেই একমাত্র নিরাপদ বিকল্প হিসেবে মনে হচ্ছে। কিন্তু, অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই নৌকাগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন উঠেছে। যাত্রীদের অনেকেই জানেন না, তারা হয়তো এই ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রার শেষ গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই দুর্ঘটনার শিকার হবেন।
নৌকাডুবির ঘটনার পর থেকে উদ্ধার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন এবং বিভিন্ন সংস্থা নিখোঁজদের সন্ধানে কাজ করে যাচ্ছে, তবে উদ্ধারকাজে নানা প্রতিবন্ধকতা দেখা দিয়েছে। লেক কিভু একটি গভীর এবং বিস্তীর্ণ লেক হওয়ায় নিখোঁজদের সন্ধান পেতে বেশ সময় লাগছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নৌকাটি ডুবে যাওয়ার পর কতজনের মৃত্যু হয়েছে, তা সঠিকভাবে জানতে আরও কয়েকদিন সময় লাগবে।
উত্তর কিভু রাজ্যের গভর্নর জানিয়েছেন, উদ্ধার হওয়া ৫৮ জন যাত্রীদের মধ্যে অনেকেই আহত অবস্থায় রয়েছেন। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে এবং অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তবে এখনও অনেক যাত্রী নিখোঁজ রয়েছেন, যাদের মরদেহ লেকের গভীরে আটকা পড়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কঙ্গোতে নৌকা দুর্ঘটনা নতুন কিছু নয়, তবে সাম্প্রতিক এই দুর্ঘটনাটি স্থলপথের অচলাবস্থা এবং রাজনৈতিক সহিংসতার প্রতিফলন। এম-২৩ গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারের সংঘর্ষের কারণে কিভুর অনেক রাস্তা অচল হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে উত্তর ও দক্ষিণ কিভু অঞ্চলে ভ্রমণ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হামলা এবং রাস্তা বন্ধ থাকার কারণে সাধারণ মানুষকে নৌপথে যাতায়াত করতে হচ্ছে।
গোমা থেকে একজন সাংবাদিক আলাইন উয়াকানি আল জাজিরাকে জানান, সহিংসতার কারণে রাস্তা বন্ধ থাকায় স্থানীয় বাসিন্দারা নৌকা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প খুঁজে পাচ্ছেন না। কঙ্গোর এই অঞ্চলে নৌযানগুলো যাত্রী পরিবহনের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে, যদিও এ পথে যাতায়াতের সময় ঝুঁকি প্রচুর। নৌকাগুলোতে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই, সঠিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকা এবং নৌকাগুলোর পুরনো অবস্থা দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।
স্থানীয় বাসিন্দারা হতাশার সঙ্গে জানিয়েছেন, তারা সরকারের কাছে আশ্রয় ও নিরাপত্তা চাইলেও সেই আশ্রয় মেলেনি। বরং নৌপথে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে তারা যাত্রা করতে বাধ্য হচ্ছেন। সরকার ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যকার সংঘাত যদি শীঘ্রই সমাধান না হয়, তবে এই ধরনের নৌকাডুবির ঘটনা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কঙ্গোর লেক কিভু দীর্ঘদিন ধরেই একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, তবে এর নৌ নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতির কারণে এটি বর্তমানে একটি বিপজ্জনক স্থান হিসেবে পরিণত হয়েছে। প্রতিনিয়ত নৌ দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যাচ্ছে, এবং এ পরিস্থিতি কঙ্গোর চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অব্যবস্থাপনার প্রতিফলন।
এই নৌপথ ব্যবহার করে যাত্রা করা যাত্রীদের অধিকাংশই হয়তো জানেন না যে তারা ঝুঁকির মুখে পড়েছেন। অনেক ক্ষেত্রেই নৌকাগুলোতে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের ফলে নৌকাগুলো ভারসাম্য হারিয়ে ডুবে যায়। নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিকভাবে নিশ্চিত করা না হলে এই ধরনের দুর্ঘটনা নিয়মিতই ঘটতে থাকবে।
কঙ্গোর নৌপথে এমন দুর্ঘটনা প্রতিরোধে অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। সরকারকে প্রথমত বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে চলমান সংঘাতের সমাধান করতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ স্থলপথে নিরাপদে ভ্রমণ করতে পারে। দ্বিতীয়ত, নৌ নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা এবং নৌযানগুলোর মান উন্নয়ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকেও কঙ্গোর এই সংকট মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে হবে। বিদ্রোহী গোষ্ঠী এবং সরকারের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সংঘাত নিরসন করা গেলে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে পারে। এছাড়া, কঙ্গোর স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য বিকল্প ভ্রমণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ও নৌপথে যাতায়াতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও উন্নত করতে হবে।
কঙ্গোর লেক কিভুতে নৌকাডুবির ঘটনা কঙ্গোর চলমান রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংকটের প্রতিচ্ছবি। এ ধরনের দুর্ঘটনা কেবলমাত্র অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের ফলাফল নয়, এটি আরও গভীর একটি সমস্যা, যা রাজনৈতিক অস্থিরতা, নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাব এবং জনগণের হতাশার প্রতিফলন। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে, কঙ্গোর মানুষ এমন দুর্যোগের সম্মুখীন হতে থাকবে, এবং এর পরিণতি হবে আরও ভয়াবহ।