ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে কাঁচা সড়ক মেরামতকে কেন্দ্র করে মাত্র ১০ টাকা নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দুটি পক্ষ, যার ফলে উভয়পক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন। পুলিশ তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং ঘটনাস্থল থেকে সাতজনকে আটক করে। সংঘর্ষের এই ঘটনাটি স্থানীয় জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে এবং পুরো এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার নোয়াগাঁও ইউনিয়নের তেরকান্দা গ্রামে একটি কাঁচা সড়ক ভেঙে যাওয়ায় সেটি মাটি ফেলে সংস্কার করেন মেম্বার গোষ্ঠীর নয়ন ও তার সহযোগীরা। এ সড়ক ব্যবহারকারী সিএনজিচালিত অটোরিকশাগুলো থেকে প্রতীকী ১০ টাকা করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়, যা এই সড়ক সংস্কারের খরচ মেটানোর উদ্দেশ্যে প্রস্তাব করা হয়।
কিন্তু মঙ্গলবার সকালে সরদার গোষ্ঠীর জুয়েল নামের এক ব্যক্তি যখন তার অটোরিকশা নিয়ে ওই সড়ক দিয়ে যাচ্ছিল, তখন নয়নের পক্ষ থেকে তার কাছে ১০ টাকা চাওয়া হয়। জুয়েল এই টাকা দিতে অনীহা প্রকাশ করেন, যা থেকে শুরু হয় কথাকাটাকাটি ও হাতাহাতি। প্রথমে এই বিষয়টি ছোটখাটো বিরোধ হিসেবে দেখা গেলেও পরে তা সংঘর্ষে রূপ নেয়।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিষয়টি সমাধানের জন্য উভয়পক্ষের লোকজন সালিশ বসায়। সালিশের উদ্দেশ্য ছিল ঝগড়ার মীমাংসা করে উত্তেজনা প্রশমিত করা, তবে পরিস্থিতি দ্রুত উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে। সালিশ চলাকালীন উভয়পক্ষের লোকজন নিজেদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা শুরু করে, যার ফলশ্রুতিতে উত্তেজনা চরমে পৌঁছে যায় এবং রাতেই ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষ শুরু হয়।
উভয়পক্ষ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, এবং এতে বেশ কয়েকজন আহত হন। পুলিশ খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছালেও পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়, এবং সংঘর্ষটি পরের দিন বুধবার সকালের দিকে পুনরায় শুরু হয়।
বুধবার (২ অক্টোবর) সকালেই উভয়পক্ষের লোকজন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আবার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী এই সংঘর্ষে অন্তত ৩০ জন আহত হন। স্থানীয়রা জানান, সংঘর্ষে রড, লাঠি, লোহার রড, এবং কাঁচের বোতল ব্যবহার করা হয়, যা পুরো এলাকা জুড়ে এক ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে।
খবর পেয়ে সরাইল থানার ওসি আব্দুর রাজ্জাক নেতৃত্বাধীন পুলিশ দল দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। সংঘর্ষ বন্ধ করার পর পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে সাতজনকে আটক করে এবং তাদের কাছ থেকে কিছু দেশীয় অস্ত্রও উদ্ধার করে।
ওসি আব্দুর রাজ্জাক গণমাধ্যমে জানান, সকাল ৭টায় তাদের কাছে খবর আসে যে তেরকান্দা গ্রামে জুয়েল ও নয়নের পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। পুলিশ তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে এবং সংঘর্ষের সাথে যারা জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে ওসি জানান।
পরিস্থিতি যাতে আবার উত্তপ্ত না হয়, সেই জন্য পুলিশের অতিরিক্ত দল মোতায়েন করা হয়েছে। স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লেও পুলিশ তাদের আশ্বস্ত করেছে যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।
ওসি আব্দুর রাজ্জাক আরও বলেন, “ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সংঘর্ষের পেছনে যেসব ব্যক্তিরা প্ররোচনা দিয়েছে, তাদেরও চিহ্নিত করে আটক করা হবে।”
এই সংঘর্ষের পেছনে মূলত কারণ ছিল কাঁচা সড়ক মেরামতের জন্য নেওয়া মাত্র ১০ টাকা। স্থানীয়রা বলছেন, এই ছোট্ট বিষয়টি এত বড় সংঘর্ষে রূপ নেবে, তা তারা কল্পনাও করতে পারেননি। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সড়ক সংস্কারের জন্য টাকা সংগ্রহের বিষয়টি সঠিকভাবে সমন্বয় করা হয়নি, যা এই উত্তেজনার মূল কারণ হতে পারে।
এছাড়া, গ্রাম্য সালিশগুলোতে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ভূমিকা এবং জনগণের মধ্যে বিশ্বাসের অভাব এই ধরনের সংঘর্ষের প্রকৃত কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। স্থানীয় প্রশাসনের উচিত এই ধরনের পরিস্থিতি দ্রুত সমাধানের জন্য দক্ষতা এবং বিচক্ষণতার সঙ্গে কাজ করা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের এই সংঘর্ষের ঘটনা স্থানীয় প্রশাসনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে, গ্রামীণ এলাকায় ছোটখাটো বিরোধ থেকে সংঘর্ষের ঘটনা প্রায়শই ঘটে থাকে, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সমাধানের পরিবর্তে জটিলতার দিকে যায়। এরকম ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে পুনরাবৃত্তি না হয়, তার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
এই ধরনের ঘটনাগুলোতে দ্রুত এবং সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমিত করা যেতে পারে। গ্রাম্য সালিশের পরিবর্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে বিরোধ মীমাংসা করার প্রক্রিয়া কার্যকর হতে পারে। এতে করে উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হবে।
এ ঘটনায় স্থানীয় জনগণের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কিছু লোকজন ঘটনার জন্য দুই পক্ষকেই দায়ী করেছেন, আবার কেউ কেউ মেম্বার পক্ষের নয়নের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন যে, তিনি বেআইনিভাবে টাকা আদায় করতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে, সরদার পক্ষের জুয়েলও সংঘর্ষে সমানভাবে দায়ী বলে মত দেন অনেকে।
গ্রামবাসীরা উদ্বিগ্ন, কারণ এই ধরনের সংঘর্ষ তাদের জীবনযাত্রাকে বিঘ্নিত করে এবং পুরো এলাকা জুড়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের এই সংঘর্ষ একটি সাধারণ গ্রামের বিরোধের চরম পরিণতির উদাহরণ। মাত্র ১০ টাকা নিয়ে শুরু হওয়া একটি বিরোধ যেভাবে বড় সংঘর্ষে রূপ নিল, তা থেকে বোঝা যায় গ্রামীণ এলাকায় সামান্য উত্তেজনাও কত বড় আকার ধারণ করতে পারে। স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের সংঘর্ষ এড়ানো যায় এবং গ্রামের শান্তি বজায় থাকে।