উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে কুড়িগ্রাম জেলার তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার এবং ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি বিপদসীমার কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। তিস্তা নদীর পানির উচ্চতা বিশেষত দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে জেলার রাজারহাট উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এতে করে পাঁচ শতাধিক পরিবারের প্রায় দেড় হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানি বৃদ্ধির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফসলি জমি, ডুবে গেছে সড়ক এবং স্থানীয় অবকাঠামো।
কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির মূল কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে উজানে ভারী বৃষ্টিপাত এবং সেই সাথে নদীর পানির উচ্চতা বৃদ্ধি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দেওয়া তথ্যমতে, তিস্তা নদীর পানি রংপুরের কাউনিয়া সেতু পয়েন্টে বিপদসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। যদিও সন্ধ্যার দিকে কিছুটা কমে বিপদসীমার ৩১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। অন্যদিকে ধরলা এবং দুধকুমার নদীর পানিও ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তবে এখনো তা বিপদসীমার নিচ দিয়ে বইছে।
রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙা এবং বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিস্তার বাম তীরে কিছুটা কম প্রভাব পড়লেও ডান তীরে পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা অনেক বেশি। শনিবার রাতে পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে গ্রামের সড়ক, ফসলি জমি, এবং বাজারের দোকানপাট পানির নিচে তলিয়ে যায়। সরিষাবাড়ি, বড় দরগা, চর খিতাবখাঁ, এবং বুড়িরহাটের মতো এলাকাগুলোর শত শত পরিবার এখন পানিবন্দি। নারী, শিশু, এবং গবাদিপশুরা রয়েছে চরম দুর্ভোগে।
বন্যার ফলে স্থানীয় কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাপকভাবে। বিশেষত সবজি ক্ষেত এবং আমন ধান পানিতে তলিয়ে গেছে, যা কৃষকদের জন্য বিরাট ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় কৃষকরা আশঙ্কা করছেন যে, পানি দ্রুত না নামলে তাদের ফসল পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে।
৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মামুন জানান, “এলাকায় হাজারো মানুষ পানিবন্দি। রাস্তাঘাট সব পানির নিচে, মানুষের জমির ফসলও তলিয়ে গেছে। দ্রুত পানি না কমলে এলাকায় খাদ্য সংকটের সৃষ্টি হবে।”
স্থানীয় ইউপি সদস্যরা জানান, কিছু এলাকার বাড়িঘরে কোমর সমান পানি ঢুকে পড়েছে। তারা আশঙ্কা করছেন, যদি পানি দ্রুত না নেমে যায় তবে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্থানীয় প্রশাসন তৎপর হয়ে উঠেছে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) আসাদুজ্জামান জানান, “উপজেলার দুই ইউনিয়নের পাঁচ শতাধিক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারিভাবে এসব পরিবারের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।” এছাড়াও ২ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা সোমবার থেকে বিতরণ করা হবে।
জেলা প্রশাসক নুসরাত সুলতানা জানিয়েছেন, “বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা তৎপর রয়েছি। পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা হচ্ছে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী আরও সহায়তা দেওয়া হবে।”
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, রংপুর বিভাগের উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমেছে। এর ফলে আগামী ১৮ ঘণ্টার মধ্যে তিস্তায় সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থেকে ধীরে ধীরে উন্নতি হতে পারে। তবে ধরলা এবং দুধকুমারের পানির স্তর বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যদিও বর্তমান পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসতে পারে বলে পূর্বাভাস রয়েছে, তবুও স্থানীয় প্রশাসন এবং সাধারণ মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষত গ্রামের কৃষকদের জন্য ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা প্রয়োজন। পানিবন্দি মানুষদের খাদ্য, চিকিৎসা, এবং আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, তবে দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনকে আরও ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
কুড়িগ্রামে চলমান বন্যা পরিস্থিতি স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। ফসলি জমি, সড়ক, এবং গ্রামীণ অবকাঠামোর ক্ষতি দীর্ঘমেয়াদী পুনরুদ্ধারের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়াবে। প্রশাসনের তৎপরতা এবং স্থানীয়দের প্রচেষ্টা বন্যার প্রভাব কিছুটা কমাতে সক্ষম হলেও ভবিষ্যৎ বন্যার জন্য প্রস্তুতি আরও জোরদার করা জরুরি।