বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতা আরও জোরদার করার বিষয়ে উভয় দেশের নেতাদের আগ্রহ বেড়েছে। নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা করেছেন। বৈঠকটি জাতিসংঘ সদর দপ্তরের নির্ধারিত সভাস্থলে ২৮ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার সকালে অনুষ্ঠিত হয়।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন। বৈঠকে তিনি বাংলাদেশে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে এই সরকার যে সংস্কার প্রক্রিয়া গ্রহণ করেছে, তা বাংলাদেশে সুস্থিতি ফিরিয়ে আনতে এবং অর্থনৈতিক বিকাশে সহায়ক হবে বলে মনে করেন তিনি।
ব্লিঙ্কেন এ বিষয়ে একমত প্রকাশ করেন এবং ড. ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশের বর্তমান সরকার দেশটির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের এই যাত্রায় পাশে থাকবে।”
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে, এবং এই সম্পর্ক আরও গভীর করার লক্ষ্যে উভয় পক্ষই সচেষ্ট। বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও জোরদার করার লক্ষ্যে নানা দিক নিয়ে আলোচনা হয়। বিশেষ করে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ধারা বজায় রাখতে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক হতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন ড. ইউনূস।
ব্লিঙ্কেন জানান, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক আরও সুসংহত করতে চায় এবং এই লক্ষ্যে তারা বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে প্রস্তুত। শ্রম মান উন্নয়ন, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো, ও ইকোনমিক রিফর্মস বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করা হয়।
রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং দীর্ঘস্থায়ী চ্যালেঞ্জ। এই বৈঠকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরুত্ব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ড. ইউনূস রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকার ওপর জোর দেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা আরও জোরদার করার আহ্বান জানান।
ব্লিঙ্কেন এ বিষয়ে সমর্থন জানিয়ে বলেন, “রোহিঙ্গা সংকট শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, এটি একটি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যু। যুক্তরাষ্ট্র এই সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান ও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।”
বাংলাদেশে সন্ত্রাস দমন ও নিরাপত্তা স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে উভয় দেশ নিবিড়ভাবে কাজ করছে। বৈঠকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ এবং নিরাপত্তা সহযোগিতা আরও সম্প্রসারণের বিষয়েও আলোচনা হয়। ব্লিঙ্কেন বলেন, “সন্ত্রাসবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা, এবং বাংলাদেশ এই লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।”
ড. ইউনূস জানান, বাংলাদেশ সন্ত্রাস দমন এবং নিরাপত্তা রক্ষায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা আরও দৃঢ় করতে চায়। সন্ত্রাসবাদ দমনে প্রয়োজনীয় তথ্য আদান-প্রদান এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে উভয় দেশই পারস্পরিক স্বার্থে কাজ করবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতি যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে শ্রমমান উন্নয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্রম অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৈঠকে শ্রম অধিকার এবং বাংলাদেশে শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আরও অবদান প্রত্যাশা করা হয়।
অর্থ পাচার রোধ এবং পাচার হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধার নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়। ড. ইউনূস বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধারে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন এবং এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চান। ব্লিঙ্কেন এই বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেন।
বৈঠকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ড. ইউনূসের নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, “ড. ইউনূস বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে অসাধারণ নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং তার নেতৃত্বে দেশটি সঠিক পথে এগিয়ে যাচ্ছে।”
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করতে এই বৈঠক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। উভয় দেশের পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সহযোগিতা আরও গভীরতর করার লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপগুলো আসন্ন সময়ে আরও কার্যকর প্রমাণিত হবে।
ড. ইউনূস ও অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের এই বৈঠকটি শুধু দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করবে না, বরং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ড. ইউনূস এবং অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের বৈঠকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো আলোচনা হয়েছে:
- বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি
- অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা
- বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীরতর করা
- শ্রম অধিকার এবং শ্রমমান উন্নয়ন
- রোহিঙ্গা সংকট এবং রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
- সন্ত্রাস দমন এবং নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদার করা
- পাচার হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধার এবং অর্থ পাচার রোধ
- ড. ইউনূসের নেতৃত্বের প্রশংসা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সমর্থন