রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) দীর্ঘদিন ধরেই দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনার শিকার। সংস্থাটির একাধিক অভিযোগ এবং অনিয়ম নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সংবাদমাধ্যমগুলো সরব রয়েছে। তবে সম্প্রতি বিআরটিসির কল্যাণপুর বাস ডিপোর সাবেক ইউনিট প্রধান নুর-ই-আলমের বিরুদ্ধে কেজি দরে বাস বিক্রির অভিযোগটি একটি নতুন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। দায়িত্বে থাকা অবস্থায় তিনি একটি সরকারি বাস কেটে বিক্রি করে দেন এবং তার বিরুদ্ধে আরও কিছু গুরুতর অভিযোগ উঠেছে।
গত বছর ৯ মার্চ, নুর-ই-আলম কল্যাণপুর ডিপোর দায়িত্বে থাকাকালীন, অনুমতি ছাড়াই ডিপোতে থাকা ঢাকা মেট্রো-চ-৭৩৬০ রেজিস্ট্রেশন নম্বরের একটি সরকারি বাস কেটে বাইরে বিক্রি করে দেন। এই অবৈধ কাজের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অভিযোগে জানা যায় যে নুর-ই-আলম কেজি দরে বাসটি বিক্রি করেছেন এবং এটি তার বিরুদ্ধে একাধিক তদন্তের সূত্রপাত করে।
এই ঘটনায় বিআরটিসির ব্যবস্থাপক (কারিগরি) মো. মনিরুজ্জামান তদন্ত করে নুর-ই-আলমের সরাসরি জড়িত থাকার প্রমাণ পান। তদন্তে দেখা যায় যে, নুর-ই-আলম শুধুমাত্র বাস বিক্রি করেননি, তিনি এই কাজের জন্য বেশ কিছু সহকর্মীকেও আর্থিক সুবিধা দিয়েছেন। এই বিষয়টি নিয়ে একটি অভিযোগনামা জমা পড়ে, যেখানে তার অসদাচরণ, প্রতারণা, এবং দায়িত্ব পালনে অবহেলার প্রমাণ পাওয়া যায়।
বিআরটিসি কর্মচারী চাকরি প্রবিধানমালা, ১৯৯০-এর ৩৯ (ক), (খ) ও (চ) ধারা অনুযায়ী, নুর-ই-আলমের দায়িত্ব পালনে অবহেলা, অসদাচরণ এবং প্রতারণার জন্য তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। যদিও তদন্তে তার অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে, এখনও পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বরং, তাকে বিআরটিসির সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
নুর-ই-আলমের সাথে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। মেসেজ দেওয়ার পরও কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে তার অবস্থান স্পষ্ট নয় এবং গণমাধ্যমের কাছে তিনি কোনো ব্যাখ্যা দেননি।
বিআরটিসির মুখপাত্র মোহাম্মদ মোবারক হোসেন মজুমদার জানিয়েছেন যে, নুর-ই-আলমের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে এবং তার বিষয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে, এত গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন তিনি এখনও সচিবের দায়িত্বে রয়েছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
নুর-ই-আলমের এই কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিআরটিসির অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতির যে চিত্র প্রকাশিত হয়েছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। একজন সরকারি কর্মকর্তা কর্তৃক এমন গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হওয়া এবং তার কোনো শাস্তি না হওয়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার পরিচায়ক। এই ঘটনাটি কেবল নুর-ই-আলমের বিরুদ্ধে নয়, বরং বিআরটিসির পুরো ব্যবস্থাপনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
বিআরটিসির বিভিন্ন সময়ের দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা এই ঘটনার আগে থেকেই পরিচিত ছিল। সংস্থাটির অনেক বাস অযত্নে পড়ে থাকার কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে। অথচ, নুর-ই-আলমের মত কর্মকর্তারা সেই বাসগুলোকে ব্যক্তিগত লাভের জন্য বিক্রি করে দিয়েছেন। এই ধরনের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে বিআরটিসির সার্বিক কার্যক্রমে বিপর্যয় ঘটছে এবং জনগণের করের টাকার অপচয় হচ্ছে।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিআরটিসির দায়িত্বশীলদের উচিত দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। নুর-ই-আলমের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে, এই ধরনের অনিয়ম ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে। একই সাথে, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা আবশ্যক।
বিআরটিসিতে নুর-ই-আলমের মত কর্মকর্তার দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা শুধুমাত্র এই প্রতিষ্ঠানকেই নয়, বরং রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় এবং জনগণের আস্থার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এই ধরনের ঘটনা থেকে মুক্তি পেতে হলে যথাযথ আইন প্রয়োগ ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।