পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক অস্থিরতা স্থানীয় অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার বাসিন্দারা ৭২ ঘণ্টার অবরোধের ফলে বিশাল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। মূলত পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকায় সবজি ও মৌসুমি ফল পচে গেছে এবং জ্বালানি সংকটের কারণে স্থানীয়দের দৈনন্দিন জীবনে নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। তবে সোমবার অবরোধ তুলে নেওয়ার পর জনজীবন কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক সংঘাতের প্রেক্ষিতে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এবং পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন নামে একটি সংগঠন ৭২ ঘণ্টার সড়ক ও নৌপথ অবরোধের ডাক দেয়। এই অবরোধের মূল কারণ হিসেবে তারা পাহাড়ি জনগণের নিরাপত্তা এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রতিকার চেয়েছে। এই সংঘাতের ঘটনায় পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভও দেখা যায়, যা স্থানীয় পরিবহন এবং ব্যবসায় প্রভাব ফেলেছে।
অবরোধের প্রভাবে পাহাড়ি অঞ্চলের অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবানের বাজারগুলিতে পণ্য সরবরাহ বন্ধ থাকায় প্রচুর কাঁচামাল, যেমন কলা, জাম্বুরা, পেঁপে, ইত্যাদি পচে গেছে। ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে এসব পণ্য বিভিন্ন স্থান থেকে আনা হয়েছিল, কিন্তু অবরোধের কারণে এগুলো বিক্রি করতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। আনুমানিক দুই কোটি টাকার কাঁচামাল নষ্ট হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
একজন ব্যবসায়ী জানান, “আমরা একেবারেই কোনো উপায় পাচ্ছি না, অনেক পণ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যদি অবরোধ আরও কয়েকদিন থাকত, তাহলে আমাদের ক্ষতির পরিমাণ আরও বেড়ে যেত।”
অবরোধের কারণে দীর্ঘপাল্লার যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। বিশেষ করে খাগড়াছড়ির সঙ্গে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ ছিল। তবে শহরের ভেতরে টমটম ও অটোরিকশা চলাচল কিছুটা স্বাভাবিক ছিল। তবে, মানিকছড়িতে পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের কারণে কিছু জায়গায় অস্থিরতা দেখা দেয়।
অবরোধের মধ্যেই রাঙামাটির একটি বৌদ্ধবিহারে ভাঙচুর এবং লুটপাটের ঘটনা ঘটে, যা স্থানীয়ভাবে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বৌদ্ধবিহারে হামলার জন্য স্থানীয় ভিক্ষুদের পক্ষ থেকে বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে। পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ বাংলাদেশ একটি সংবাদ সম্মেলন করে পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরেছে, যার মধ্যে রয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধবিহার পুনর্নির্মাণ এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।
সংবাদ সম্মেলনে পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের সভাপতি শ্রদ্ধালঙ্কার মহাথের বলেন, “আমাদের বৌদ্ধবিহারে যারা হামলা চালিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক এবং পবিত্র বুদ্ধমূর্তি ভাঙচুরের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে হবে।”
অবরোধের কারণে রাঙামাটির সাজেক এলাকায় প্রায় ১৫০০ পর্যটক এবং ১৭৮টি পর্যটকবাহী গাড়ি আটকা পড়ে। বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ থাকায় জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হলেও জ্বালানি সংকটের কারণে এই ব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ফলে কটেজগুলোর অনেক জেনারেটর বন্ধ হয়ে গেছে এবং পর্যটকদের জন্য পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
এক পর্যটক আল আমিন বলেন, “খাবার এবং পানির সংকটের কারণে আমরা খুব কষ্টে আছি। যত দ্রুত সম্ভব আমরা সুস্থভাবে বাড়ি ফিরে যেতে চাই।”
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান জানিয়েছেন, সাজেকে আটকে পড়া পর্যটকদের সমস্যা সমাধানে প্রশাসন কাজ করছে এবং তাদের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে তারা অবগত।
অবরোধের শেষ দিন বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র-জনতা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে সাত দফা দাবি জানায়। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল পাহাড়ি জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার তদন্ত করা। এছাড়াও, নিহতদের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা প্রদানসহ আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি উঠে আসে।
অবরোধ তুলে নেওয়ার পর পার্বত্য অঞ্চলে জনজীবন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও, এই অস্থিরতা স্থানীয় অর্থনীতি এবং জনগণের জীবনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে। ব্যবসায়ীরা দ্রুত ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছেন, এবং স্থানীয় পর্যটন শিল্পকেও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এই অঞ্চলের পুনর্গঠনে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক সংঘাত ও অবরোধের কারণে সৃষ্ট সংকট স্থানীয় অর্থনীতি এবং জনজীবনের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। মৌসুমি ফল ও কাঁচামালের ক্ষতি, যান চলাচলে বাধা এবং পর্যটন শিল্পে ধাক্কা এই অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। তবে, অবরোধ তুলে নেওয়ার পর থেকে জনজীবন কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই অঞ্চলের নিরাপত্তা এবং শান্তি কীভাবে পুনরুদ্ধার করা যাবে এবং এ ধরনের সংকট কিভাবে এড়ানো সম্ভব।
এদিকে স্থানীয় জনগণের দাবি এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের অস্থিরতা এড়ানো যায় এবং পাহাড়ি জনগণ তাদের নিরাপদ ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বজায় রাখতে পারে।