বাংলাদেশ রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্টস্ (বিআরআইসিএম)-এ সম্প্রতি এক অদ্ভুত ও গোপন কক্ষের সন্ধান পাওয়া গেছে, যা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যবহৃত হতো বলে তদন্তকারীরা দাবি করেছেন। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মালা খান এই কক্ষটি ব্যবহার করতেন বলে জানা গেছে। গোপন কক্ষটির সন্ধান পাওয়ার পর থেকে বিভিন্ন তথ্য উদঘাটন হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির ভেতরের দুর্নীতি ও অসামাজিক কার্যকলাপ নিয়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।
অনুসন্ধানকারীদের মতে, এই গোপন কক্ষটি ছিল সাধারণ চোখের আড়ালে। কক্ষটি একটি আয়নার পিছনে লুকানো ছিল, এবং সেখানে প্রবেশ করতে হলে একটি বিশেষ বোতাম চাপতে হত। অনেকেই এর আগে এই কক্ষটির বিষয়ে জানলেও মুখ খুলতে সাহস পাননি। তবে সাম্প্রতিক অনুসন্ধান ও বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে কক্ষটির ভেতরে প্রবেশ করে তদন্তকারীরা কিছু চাঞ্চল্যকর সামগ্রী উদ্ধার করেছেন। কক্ষটির ভেতরে গর্ভাবস্থা পরীক্ষার কিট, কাটা চুল, এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত জিনিসপত্র পাওয়া গেছে।
এগুলি কক্ষটিতে কীভাবে এবং কেন ব্যবহার করা হতো, তা নিয়ে তদন্ত চলছে। তবে প্রাথমিক ধারণা করা হচ্ছে, এই গোপন কক্ষে ড. মালা খান এবং তার সহকর্মীরা বিভিন্ন অনৈতিক কার্যকলাপ করতেন।
ড. মালা খানের বিরুদ্ধে শুধু গোপন কক্ষে অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগই নয়, তার বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি ও চুরির অভিযোগও উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক প্রকল্পে বরাদ্দকৃত অর্থ তিনি ব্যক্তিগতভাবে আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ড. মালা খান বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। তবে তার নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। নিয়োগ পরীক্ষায় তিনি সর্বনিম্ন নম্বর পেয়েও পরীক্ষায় পাস করেছেন এবং মাস্টার্স ও এমফিল ছাড়াই পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
বিশেষ করে তার পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে বিতর্ক সবচেয়ে বেশি। তিনি যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন, তা অনুমোদিত নয় এবং প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ভুয়া ডিগ্রি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ড. মালা খানের পিএইচডি তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন তার স্বামী কে এম মোস্তফা আনোয়ার, যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে।
বিআরআইসিএম-এর প্রায় ১০০ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং কর্মচারী এই ঘটনার সাথে জড়িত অভিযোগগুলো নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নীরব ছিলেন। তবে সাম্প্রতিক অনুসন্ধান ও অভিযোগ প্রকাশের পর অনেকেই মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তাদের মতে, ড. মালা খান দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞান চর্চার আড়ালে অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিলেন।
একজন কর্মকর্তা বলেন, “আমরা অনেক দিন ধরেই কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করছিলাম। তবে কেউ কিছু বলার সাহস পায়নি। কিন্তু সাম্প্রতিককালে যা ঘটছে, তা আমাদের মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। আমরা বিজ্ঞান চর্চার জন্য এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, কিন্তু এখানে যা ঘটছে, তা বিজ্ঞান থেকে অনেক দূরে।”
অনেক কর্মচারী দাবি করেছেন, তারা বহুদিন ধরেই এই কক্ষটির অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতেন, তবে এর ভিতরের কার্যকলাপ সম্পর্কে সঠিকভাবে কিছু জানতেন না। তবে সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে প্রাপ্ত প্রমাণগুলো তাদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলেছে।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিজ্ঞান ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে অনৈতিক কার্যকলাপ ও দুর্নীতির প্রশ্ন উঠেছে। বিআরআইসিএম-এর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে এমন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ দেশের বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার প্রতি জনগণের আস্থা কমিয়ে দিতে পারে।
বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক মহল থেকে এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে। বিজ্ঞানীদের এমন আচরণ সমাজের প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞার পরিচায়ক বলে মনে করছেন অনেকে। তারা বলছেন, এই ধরনের ঘটনা দেশের সুনাম ও ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
একজন বিজ্ঞানী বলেন, “বিজ্ঞান আমাদের সমাজের জন্য একটি মূল্যবান সম্পদ। কিন্তু যদি এই ধরনের ঘটনার মাধ্যমে বিজ্ঞান ও গবেষণার নামে দুর্নীতি হয়, তাহলে আমরা জাতি হিসেবে পিছিয়ে পড়ব।”
সরকার ইতিমধ্যে এই ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এই ঘটনার সত্যতা উদঘাটনে ব্যাপক তদন্ত শুরু করেছেন। মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, “এমন অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর এবং আমরা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিচ্ছি। আমরা দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”
বিআরআইসিএম-এর এই ঘটনা দেশের বিজ্ঞান ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে চলমান অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রকাশ করেছে। দেশের বিজ্ঞান ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি এভাবে চালানো হয়, তাহলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। এই ঘটনার তদন্তের ফলাফল এবং ড. মালা খানের বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপগুলি দেশের বিজ্ঞান খাতের ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।