ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যকে একত্রে “সেভেন সিস্টার্স” বলা হয়। এই রাজ্যগুলো হলো অরুণাচলপ্রদেশ, মেঘালয়, আসাম, মণিপুর, মিজ়োরাম, নাগাল্যান্ড, এবং ত্রিপুরা। এই নামটি প্রথমে জনপ্রিয় হয় ১৯৭২ সালে, যখন ত্রিপুরার সাংবাদিক জ্যোতি প্রকাশ সাইকিয়া একটি রেডিও টক-শোতে এই সাতটি রাজ্যকে “সেভেন সিস্টার্স” বলে আখ্যায়িত করেন। এরপর তিনি “ল্যান্ড অফ সেভেন সিস্টার্স” নামে একটি বই লেখেন, যা এই নামকে আরও পরিচিত করে তোলে।
এই রাজ্যগুলো ভারত এবং এর প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বিভিন্ন কারণে প্রায়ই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। সম্প্রতি ড. মুহাম্মদ ইউনুসের একটি মন্তব্যের জেরে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নতুন করে আলোচনায় আসে। সেভেন সিস্টার্স অঞ্চলটির ভৌগোলিক এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, জাতিগত সংঘাত, এবং রাজনৈতিক জটিলতা এই রাজ্যগুলোকে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় আলাদা করে তুলেছে।
অরুণাচল:
অরুণাচল প্রদেশ ভারতের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত একটি স্থলবেষ্টিত রাজ্য, যা তার ভৌগোলিক অবস্থান এবং বৈচিত্র্যময় ভূপ্রকৃতির জন্য বিখ্যাত। রাজ্যের দক্ষিণে আসাম, পশ্চিমে ভুটান, উত্তর ও উত্তর-পূর্বে চীন, এবং পূর্বে মিয়ানমার। অরুণাচল প্রদেশের আয়তন ৮৩,৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এবং এর রাজধানী ইটানগর।
অরুণাচল প্রদেশের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য এবং জলবায়ুর কারণে এখানে বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ এবং প্রাণীজীবনের দেখা মেলে। বাঘ, চিতা বাঘ, তুষার চিতা, হাতি, লাল পান্ডা, এবং হরিণ এই অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম। প্রদেশটির ভূখণ্ড উঁচুনিচু, ঢালযুক্ত এবং এলোমেলোভাবে বিস্তৃত, যা প্রদেশটিকে একটি বিশেষ মাত্রা দিয়েছে। এছাড়াও, রাজ্যের অংশ হিসেবে বিশাল হিমালয়ের উচ্চশৃঙ্গ রয়েছে, যা এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং বৈচিত্র্যকে আরও বৃদ্ধি করেছে।
অরুণাচল প্রদেশের চীনের তিব্বতের সাথে ১১২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে, যা রাজ্যটির ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বকেও নির্দেশ করে।
আসাম:
আসাম ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য, যা ১৮২৬ সালে ইয়াণ্ডাবু চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। স্বাধীনতার পর আসাম রাজ্যের পুনর্গঠন হয় এবং এর বর্তমান নামকরণ হয়। রাজ্যের ভূ-প্রকৃতি অসমতল হওয়ার কারণে এটি ‘অসম’ নামে পরিচিতি পায়, যা পরবর্তীতে ‘আসাম’ নাম ধারণ করে। আসামের আয়তন ৭৮,৪৩৮ বর্গকিলোমিটার এবং এটি ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, মিজোরাম, মণিপুর, ও অরুণাচল প্রদেশ দ্বারা পরিবেষ্টিত।
আসামের আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে ভুটান এবং বাংলাদেশের সাথে। এটি ভারতের উত্তর-পূর্ব দিকের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত এবং তার ঘন সবুজ বন, উর্বর সমভূমি, বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদী, সুন্দর পাহাড়, নীলাভ পর্বত, বিস্ময়কর চা চাষের উপত্যকা এবং বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীকূল দ্বারা সমৃদ্ধ।
আসাম রাজ্যের অর্থনীতিতে চা চাষ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি ভারতের চা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র এবং বিশ্বব্যাপী আসাম চা তার উচ্চ মানের জন্য পরিচিত। এছাড়াও, আসামের বিভিন্ন অভয়ারণ্য এবং জাতীয় উদ্যানগুলিতে একাধিক বিরল ও বিপন্ন প্রাণীর আবাসস্থল রয়েছে, যা প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়।
মেঘালয়:
মেঘালয় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি সুন্দর রাজ্য, যার রাজধানী শিলং। এটি ভারতের ২১তম রাজ্য হিসেবে পরিচিত এবং এর আয়তন ২২,৪২৯ বর্গকিলোমিটার। মেঘালয় রাজ্যটি গারো পাহাড়, খাসি পাহাড়, এবং জয়ন্তিয়া পাহাড়ের সমন্বয়ে গঠিত, যা রাজ্যের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
মেঘালয়ের সৃষ্টি হয় ১৯৭০ সালে, যখন এটি আসামের দুটি জেলা থেকে পৃথক হয়ে একটি স্বতন্ত্র রাজ্যে পরিণত হয়। তবে মেঘালয়ের ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ উল্লেখযোগ্য, বিশেষত ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বাংলা ভাগের সময়, যখন এটি পূর্ব বাংলা এবং আসামের একটি নতুন প্রাদেশিক অংশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
মেঘালয়কে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও মনোরম পরিবেশের জন্য ‘প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড’ বলা হয়। রাজ্যটির পাহাড়ি এলাকাগুলো, মেঘে আচ্ছাদিত আকাশ, জলপ্রপাত, এবং ঘন সবুজ বনাঞ্চল এর সৌন্দর্যকে আরও মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে। মেঘালয় তার সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের জন্যও পরিচিত, যেখানে বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী বসবাস করে, যারা তাদের নিজস্ব ভাষা, সংগীত, নৃত্য, এবং জীবনধারার মাধ্যমে তাদের সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করে চলেছে।
মিজোরাম:
মিজোরাম ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি ছোট এবং মনোমুগ্ধকর রাজ্য, যার রাজধানী আইজল। রাজ্যটি উত্তর ও দক্ষিণ লুসাই পার্বত্য জেলাগুলোর সমন্বয়ে গঠিত এবং এর আয়তন ২১,০৮৭ বর্গকিলোমিটার। মিজোরাম ভারতের ২৩তম রাজ্য হিসেবে পরিচিত।
মিজোরামের সীমানা প্রায় ৭২২ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের সাথে যুক্ত। এই দীর্ঘ সীমানা রাজ্যটিকে একটি ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে এসেছে।
মিজোরাম রাজ্যটি তার বিশাল পাইনের গুচ্ছ, নান্দনিক প্রাকৃতিক দৃশ্য, এবং বাঁশের ওপর নির্মিত ঘরগুলো নিয়ে গঠিত গ্রামগুলোর অপূর্ব সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। রাজ্যের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং পরিবেশ পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।
মিজোরামের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো খ্রিস্টীয় ১৭৫০ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে মিজো উপজাতির আগমন। তারা নিকটস্থ চীন পর্বত থেকে এসে এখানকার স্থানীয় আদিবাসীদের পরাজিত করে বসতি স্থাপন শুরু করে। এই মিজো উপজাতিরা তাদের নিজস্ব সমাজব্যবস্থা এবং সংস্কৃতি গড়ে তোলে, যা আজও রাজ্যের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে।
নাগাল্যান্ড:
নাগাল্যান্ড ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র রাজ্য, যার রাজধানী কোহিমা এবং বৃহত্তম শহর ডিমাপুর। রাজ্যটির আয়তন ১৬,৫৭৯ বর্গকিলোমিটার, যা এটিকে ভারতের ক্ষুদ্রতম রাজ্যগুলির মধ্যে একটি করে তুলেছে।
নাগাল্যান্ডের ইতিহাস একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল সময়ের সাক্ষী। ভারতের স্বাধীনতার ঠিক আগের দিন, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট, নাগা জনগণ নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। তবে এই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। ১৯৫১ সালের মে মাসে নাগাল্যান্ডে একটি স্বতঃস্ফূর্ত গণভোট অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে নাগা জনগণ স্বাধীনতার পক্ষে পূর্ণ সমর্থন প্রকাশ করে। তবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তাদের এই দাবির প্রতি সমর্থন দেয়নি।
এই পরিস্থিতির মধ্যে নাগাল্যান্ডে দীর্ঘ সময় ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলতে থাকে। অবশেষে, ১৯৬৩ সালে আসাম থেকে আলাদা করে নাগাল্যান্ডকে ভারতের ১৬তম রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর মাধ্যমে নাগাল্যান্ডের একটি স্বতন্ত্র পরিচিতি গড়ে ওঠে এবং রাজ্যটি ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান করে।
ত্রিপুরা:
ত্রিপুরা ভারতের তৃতীয় ক্ষুদ্রতম রাজ্য, যার আয়তন ১০,৪৯১ বর্গকিলোমিটার এবং রাজধানী আগরতলা। এটি জনসংখ্যার দিক থেকেও সপ্তম সর্বনিম্ন জনবহুল রাজ্য। ত্রিপুরা বাংলাদেশ দ্বারা তিন দিক থেকে বেষ্টিত, এবং রাজ্যে ১৯টি ভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায় সহ সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি বাস করে। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, ত্রিপুরা ভারতের অন্যতম শিক্ষিত রাজ্য, যেখানে সাক্ষরতার হার প্রায় ৮৭.৭৫%। ত্রিপুরা ১৯৪৯ সালে স্বাধীন ভারতের অংশ হয় এবং ১৯৫৬ সালে এটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এবং পরবর্তীতে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে।
মণিপুর:
মণিপুর রাজ্যের রাজধানী হলো ইম্ফল, যার আয়তন প্রায় ২২,৩২৭ বর্গকিলোমিটার। মণিপুরে তিনটি প্রধান গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের বাস: বিষ্ণুপ্রিয়া, মৈতৈ, এবং পাঙান। ১৯৭২ সালে মণিপুর পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে। এটি ভারতের অন্যতম সুন্দর রাজ্য এবং এখানেই বিরল প্রজাতির হরিণ ‘সাংগাই’ এর বসবাস।
সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলো ভৌগোলিকভাবে একে অপরের সাথে সংযুক্ত হলেও সংস্কৃতি, ভাষা, এবং জীবনধারার ক্ষেত্রে আলাদা বৈশিষ্ট্য বহন করে। তবে রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং অর্থনৈতিকভাবে তারা একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে এ রাজ্যগুলোর যোগাযোগের একমাত্র সরু পথ হলো “চিকেন নেক করিডোর”, যা পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে অবস্থিত।
সম্প্রতি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মন্তব্যের পর এই সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলো নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের সরকারকে এই পরিস্থিতিতে অত্যন্ত সচেতনভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে দেশটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। সঠিক সিদ্ধান্ত না নিলে, এটি বাংলাদেশের জন্য চরম বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে।