রংপুরে সংবাদ সম্মেলনে সতর্ক করলেন এনসিপি নেতা সারজিস আলম
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, “জুলাই সনদ বাস্তবায়ন না করে এবং জুলাই আন্দোলন ও গণহত্যার বিচার না করে যদি কোনোভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একমুখী চিন্তা থেকে দায়সারা নির্বাচন করতে চায়, তাহলে তাদের সবার আগে জুলাই যোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের মুখোমুখি হতে হবে। এতে কোনো রাজনৈতিক দল লাগবে না।”
রোববার (১৯ অক্টোবর) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় নগরীর হোটেল তিলোত্তমায় এনসিপির রংপুর জেলা ও মহানগর সমন্বয় সভা শেষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ বক্তব্য দেন।
সারজিস আলম বলেন, “যেভাবে রাজনৈতিক দল ছাড়াই শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারকে ছাত্রজনতা ও তরুণ সমাজ মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে পতন ঘটিয়েছে, তেমনি এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি জনআকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করে একমুখী নির্বাচন আয়োজন করতে চায়, তবে জুলাই যোদ্ধা ও শহীদ পরিবাররাই রাজনৈতিক দল ছাড়াই তাদের প্রতিরোধ করবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা কোনো সংঘাত চাই না। কিন্তু জনগণের রক্ত ও আত্মত্যাগে অর্জিত জুলাই আন্দোলনের চেতনা যদি উপেক্ষিত হয়, তবে এ দেশের মানুষ চুপ করে বসে থাকবে না।”
সংবাদ সম্মেলনে সারজিস আলম সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার তীব্র সমালোচনা করে বলেন, “দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সিরিজ আকারে যে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে, তা নিছক দুর্ঘটনা নয়। এটি একটি সুপরিকল্পিত চক্রান্ত, যার কলকাঠি নাড়ছে ফ্যাসিস্ট চক্র।”
তার দাবি, “এই চক্র অডিও ও ভিডিও নির্দেশনার মাধ্যমে এসব ঘটনার পেছনে কাজ করছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনগণের জীবনের জন্য এটি বড় হুমকি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এখনই কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।”
তিনি বলেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি এসব নাশকতামূলক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কঠোর তদারকি না করে, তাহলে নির্বাচনের আগে দেশ আবারও অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে। জনমনে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি অপরিহার্য।”
এনসিপির মুখ্য সংগঠক বলেন, “দেশের সব রাজনৈতিক দলই জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি চায়। বিএনপিসহ কিছু দলের কিছু বিষয়ে দ্বিমত থাকলেও তারা সবাই এই সনদে সাক্ষর করেছে। তবে তাদের সাক্ষরকে দায়সারা মনোভাবের সাক্ষর হিসেবে দেখা হচ্ছে।”
তিনি স্পষ্ট করে বলেন, “আমরা চাই জুলাই সনদ কেবল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ না থেকে আইনি ও সাংবিধানিক ভিত্তি পাক। এটাই দেশের মানুষের প্রত্যাশা।”
সারজিস আলম বলেন, “এ দেশের মানুষ জুলাই আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষায় এনসিপিকে দেখেছে। আমরা এই আন্দোলনের ফসল হিসেবে জন্ম নেওয়া একটি রাজনৈতিক শক্তি। যতদিন দেশের মানুষ মুক্তি ও ন্যায়ের রাজনীতি চাবে, ততদিন এনসিপি প্রাসঙ্গিক থাকবে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “এনসিপি শুধু ক্ষমতার রাজনীতি করে না, এটি একটি চেতনার রাজনীতি। জুলাই আন্দোলনে যারা জীবন দিয়েছে, তাদের রক্তের ঋণ শোধ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম থামবে না।”
‘জুলাই আন্দোলন’ হিসেবে পরিচিত এ গণজাগরণ ছিল সাম্প্রতিক ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক মোড়। এই আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের জনগণ দীর্ঘদিনের ফ্যাসিস্ট শাসনের অবসান ঘটিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্ম দেয়। কিন্তু আন্দোলনে নিহতদের বিচার ও জুলাই সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন এখনো হয়নি, যা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র বিতর্ক চলছে।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ছাড়া দেশের গণতান্ত্রিক যাত্রা সম্পূর্ণ হবে না। এই সনদের মূল লক্ষ্য ছিল জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থা, নির্দলীয় নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার সুরক্ষা এবং রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা।
সারজিস আলম বলেন, “এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করা। মানুষ যদি মনে করে এই সরকারও আগের মতো একমুখী চিন্তা করছে, তাহলে তারা রাস্তায় নেমে আসবে। তখন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।”
তিনি সরকারকে সতর্ক করে বলেন, “জুলাই আন্দোলনের শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দেওয়া হবে না। আমরা সংলাপ, আইনগত কাঠামো ও রাজনৈতিক ঐক্যের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। কিন্তু যদি কেউ ষড়যন্ত্র করে জুলাই সনদকে পাশ কাটাতে চায়, তাহলে আমরা রাজপথেই এর জবাব দেব।”
রংপুরের হোটেল তিলোত্তমায় অনুষ্ঠিত এই সভায় এনসিপির কেন্দ্রীয়, জেলা ও মহানগর পর্যায়ের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন রংপুর মহানগর এনসিপির আহবায়ক মিজানুর রহমান মিজান।
সভায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ফারুক হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক নাজমুল ইসলাম, রংপুর জেলা এনসিপির সাধারণ সম্পাদক আনিসুজ্জামান এবং মহানগর শাখার যুগ্ম আহবায়ক লায়লা পারভিন।
সভার পর অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে দলীয় অবস্থান পরিষ্কার করেন সারজিস আলম। তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, “আমরা চাই দেশ এগিয়ে যাক গণতন্ত্র ও ন্যায়ের পথে। কিন্তু সেই পথে বাধা হলে এনসিপি নীরব থাকবে না।”
সংবাদ সম্মেলনের পর রংপুরের রাজনৈতিক মহলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এনসিপির এই বার্তা কেবল রাজনৈতিক হুঁশিয়ারি নয়, এটি জনগণের ক্রমবর্ধমান হতাশা ও অনিশ্চয়তার প্রতিফলন।
রংপুরের রাজনীতি পর্যবেক্ষক অধ্যাপক আব্দুল হাকিম বলেন, “জুলাই আন্দোলনের পর মানুষের প্রত্যাশা ছিল—অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গণতান্ত্রিক সংস্কার দ্রুত বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু যদি সেটি না হয়, তাহলে সত্যিই নতুন সামাজিক প্রতিরোধ দেখা দিতে পারে।”
সারজিস আলমের বক্তব্যে স্পষ্ট, এনসিপি এখনো জুলাই আন্দোলনের চেতনা ও সনদের বাস্তবায়নকেই রাজনীতির কেন্দ্রে রাখতে চায়। তাদের এই বার্তা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য একটি বড় সতর্ক সংকেত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তিনি যে ভাষায় বলেছেন, তা যেন এক ধরনের গণআন্দোলনের পূর্বাভাস—
“আমরা কাউকে শত্রু মনে করি না, কিন্তু যারা জনগণের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে, তারা ইতিহাসের আসামি হয়ে থাকবে।”