শরীয়তপুরে বিএনপি নেতার পদত্যাগে আলোচনার ঝড়
দলীয় কার্যক্রমে হতাশা প্রকাশ করে শরীয়তপুরের সখিপুর উপজেলার বিএনপি নেতা মনোয়ার হোসেন বাবু বকাউল দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে দলের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত থাকা এই নেতার পদত্যাগে স্থানীয় রাজনীতিতে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তিনি সখিপুর থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও চরভাগা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন।
রোববার (১৯ অক্টোবর) দুপুরে শরীয়তপুর জেলা বিএনপির সভাপতি বরাবর তিনি লিখিতভাবে পদত্যাগপত্র জমা দেন। পাশাপাশি নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে একটি পোস্ট দেন।
লিখিত পদত্যাগপত্রে মনোয়ার হোসেন বাবু বকাউল উল্লেখ করেন,
“আমি মো. মনোয়ার হোসেন বাবু বকাউল, সখিপুর থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছি। শুরু থেকে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু দলের আদর্শগত কারণ ও বর্তমান কার্যক্রমে আমি গভীরভাবে হতাশ। তাই নিজের বিবেকের তাড়নায় বিএনপির সব পদ থেকে অব্যাহতি নিচ্ছি।”
তার বক্তব্যে ফুটে উঠেছে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সংগঠনের প্রতি আস্থা হারানোর বেদনা।
মিডিয়াকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় বাবু বকাউল বলেন, “আমি শুরু থেকেই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম এবং দলের কর্মসূচিতে সক্রিয় থেকেছি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কিছু নেতিবাচক কর্মকাণ্ড আমাকে মানসিকভাবে ভেঙে দিয়েছে। আমি আর দলের কোনো কর্মকাণ্ডে থাকতে চাই না। এটাই আমার ফাইনাল সিদ্ধান্ত।”
তিনি আরও বলেন, “দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে চাই না, তবে আমার পদত্যাগ কোনো আবেগের ফল নয়, এটি বিবেকের সিদ্ধান্ত।”
শরীয়তপুর জেলা বিএনপির সভাপতি শফিকুর রহমান কিরণ বলেন, “আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার পদত্যাগের খবর দেখেছি। তবে এখনো অফিসিয়ালি কোনো চিঠি হাতে পাইনি। হাতে পেলে বিষয়টি যাচাই করে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।”
জেলা কমিটির একাধিক নেতা জানান, স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় কাঠামো ও নেতৃত্ব নিয়ে কিছুদিন ধরে অসন্তোষ বিরাজ করছিল। পদত্যাগের ঘটনাটি হয়তো তারই বহিঃপ্রকাশ।
মনোয়ার হোসেন বাবু বকাউল সখিপুরে জনপ্রিয় একজন স্থানীয় রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার পদত্যাগের পর স্থানীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার ঝড় বইছে। অনেকে মনে করছেন, বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ে দীর্ঘদিন ধরে সাংগঠনিক দুর্বলতা, নেতৃত্ব সংকট ও নিষ্ক্রিয়তার কারণে অনেক নেতা হতাশ হচ্ছেন।
একজন স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, “দলীয় কর্মকাণ্ডে উদ্যম ও নেতৃত্বের ঘাটতি থাকলে তৃণমূলের নেতাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়। বাবু বকাউলের পদত্যাগ সেই দীর্ঘস্থায়ী সংকটেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে।”
চরভাগা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান হিসেবে বাবু বকাউল একসময় এলাকায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল নিবিড়। তার পদত্যাগের খবর স্থানীয়দের মাঝেও হতাশা সৃষ্টি করেছে।
চরভাগার এক বাসিন্দা বলেন, “বাবু ভাই সবসময় এলাকার মানুষের পাশে ছিলেন। তার মতো একজন পরিশ্রমী নেতা রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ালে সেটা শুধু দলের জন্য নয়, এলাকার জন্যও ক্ষতির।”
বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপির বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামোতে তৃণমূল নেতারা পর্যাপ্ত মূল্যায়ন পাচ্ছেন না—এমন অভিযোগ বহুদিনের। অনেকেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ না পাওয়ায় অসন্তুষ্ট।
দলীয় কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয়তা, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণে তৃণমূলের মতামতের অভাব—এই তিনটি বিষয়কে বর্তমান সংকটের মূল কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এক স্থানীয় বিএনপি নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “দল এখন এমন অবস্থায় আছে যেখানে তৃণমূলের কণ্ঠ কেউ শুনতে চায় না। নেতৃত্বে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর প্রভাব এত বেশি যে, বাকিদের অংশগ্রহণ সীমিত হয়ে গেছে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই পদত্যাগ কেবল একজন নেতার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নয়, বরং তৃণমূল পর্যায়ে জমে থাকা ক্ষোভের প্রতিফলন।
ঢাকার এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, “যদি স্থানীয় পর্যায়ে একের পর এক এমন পদত্যাগ ঘটে, তাহলে বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়বে। দলটির উচিত এখনই অভ্যন্তরীণ সংস্কার ও পুনর্মূল্যায়ন শুরু করা।”
১. দলীয় কর্মসূচিতে নিষ্ক্রিয়তা ও হতাশা: দীর্ঘ সময় ধরে কোনো কার্যকর আন্দোলন না হওয়ায় তৃণমূল নেতাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে।
২. নেতৃত্ব সংকট: সখিপুর থানা বিএনপির একাধিক উপকমিটি স্থবির হয়ে আছে, যা কার্যক্রমে স্থবিরতা এনেছে।
৩. ব্যক্তিগত মতভেদ: স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার নিয়ে মতবিরোধও ভূমিকা রাখতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই পদত্যাগ স্থানীয় বিএনপিতে একধরনের অস্থিরতা তৈরি করবে। বিশেষত, তৃণমূল নেতারা যদি একে অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখেন, তাহলে ভবিষ্যতে আরও নেতাদের পদত্যাগের আশঙ্কা রয়েছে।
একজন সাবেক জেলা বিএনপি নেতা বলেন, “এটি শুধুমাত্র সখিপুর নয়, পুরো জেলার জন্যই একটি সতর্ক সংকেত। দলকে এখনই অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠন করতে হবে।”
মনোয়ার হোসেন বাবু বকাউলের পদত্যাগ কেবল একটি প্রশাসনিক ঘোষণা নয়, এটি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। যখন রাজনীতিতে আদর্শের জায়গা ক্ষীণ হয়ে আসে, তখন সৎ ও পরিশ্রমী নেতাদের মনে এমন ‘বিবেকের তাড়না’ জাগে।
স্থানীয় রাজনীতির এই ঘটনাটি হয়তো জাতীয় পর্যায়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হবে না, কিন্তু এটি স্পষ্ট করে দিয়েছে—দলের ভেতরে সংস্কারের দাবি এখন সময়ের অনিবার্য প্রয়োজন।