জবি ছাত্রদল নেতা জুবায়েদ হত্যাকাণ্ড: সিসিটিভিতে ধরা পড়ল দুই যুবক
পুরান ঢাকার আরমানিটোলার এক গলির ভেতরে ঘটেছে এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য জুবায়েদ হোসাইনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তার রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার হওয়ার পর থেকে পুরো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নেমে এসেছে শোকের ছায়া, আর তদন্তকারীদের হাতে এসেছে একাধিক চাঞ্চল্যকর তথ্য।
রোববার (১৯ অক্টোবর) সন্ধ্যায় আরমানিটোলার পানির পাম্প গলির একটি পুরোনো ভবনের সিঁড়িতে পড়ে থাকতে দেখা যায় ২৪ বছর বয়সী জুবায়েদের নিথর দেহ। রক্তে ভেসে থাকা সেই সিঁড়ি এখন হয়ে উঠেছে রহস্যের কেন্দ্রবিন্দু। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, খুনের ঘটনাটি পরিকল্পিত এবং হত্যাকারীরা খুনের পরপরই পালিয়ে যায়।
ঘটনার পর পুলিশ আশপাশের ভবনের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে। একটি ফুটেজে দেখা যায়, হত্যার সময়ের কাছাকাছি সময়ে দুই যুবক দ্রুত দৌড়ে পালাচ্ছে। একজনের গায়ে কালো রঙের টি-শার্ট, আর অন্যজনের গায়ে গোলাপি। তবে ফুটেজটি অস্পষ্ট হওয়ায় তাদের মুখ চেনা যায়নি।
পুলিশের এক তদন্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “আমরা ওই দুই যুবকের গতিপথ বিশ্লেষণ করছি। তাদের চিহ্নিত করতে আশপাশের আরও ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে।”
প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, দৌড়ে পালানো ওই দুই যুবকের মধ্যে একজন নাকি জুবায়েদের টিউশনি করা ছাত্রীর বয়ফ্রেন্ড। বিষয়টি এখন পুলিশের বিশেষ নজরে রয়েছে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, জুবায়েদ নিয়মিত ওই বাসায় টিউশনি করাতেন। ঘটনার দিনও তিনি বিকেলে সেখানে গিয়েছিলেন। কিন্তু সন্ধ্যার পরপরই ভবনের বাসিন্দারা সিঁড়িতে রক্তের দাগ দেখতে পান এবং বিষয়টি পুলিশকে জানান।
বংশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমরা খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যাই এবং মরদেহ উদ্ধার করি। বাসাটিতে জুবায়েদ টিউশনি করতেন। কে বা কারা তাকে হত্যা করেছে তা এখনো নিশ্চিত নই, তবে তদন্ত চলছে।”
জুবায়েদ হোসাইন ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। পাশাপাশি তিনি কুমিল্লা জেলা ছাত্র কল্যাণ পরিষদের সভাপতি এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য হিসেবে সক্রিয় ছিলেন।
তার সহপাঠী ও সংগঠনের নেতাকর্মীরা জানান, জুবায়েদ ছিলেন পরিশ্রমী, নির্ভীক ও সৎ ছাত্রনেতা। রাজনীতিতে তিনি কখনো ব্যক্তিস্বার্থে আপস করেননি।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রদল নেতা বলেন, “জুবায়েদ আমাদের অনুপ্রেরণা ছিল। সে কখনো কারও সঙ্গে বিরোধে জড়াত না। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার না হলে আমাদের কেউ নিরাপদ নয়।”
তদন্তে থাকা সূত্র বলছে, হত্যাকাণ্ডটি একেবারে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার ফল হতে পারে, আবার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের আক্রমণও হতে পারে।
তদন্ত কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, “আমরা দুটি দিক থেকে তদন্ত করছি—এক, ব্যক্তিগত সম্পর্কজনিত বিরোধ; দুই, রাজনৈতিক শত্রুতা। ঘটনাস্থল থেকে কয়েকটি বস্তু উদ্ধার করা হয়েছে যা ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।”
তদন্তে সহায়তা করতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের একটি বিশেষ দলও মাঠে নেমেছে। তারা শুধু সিসিটিভি নয়, আশপাশের মোবাইল ফোন টাওয়ারের কল রেকর্ডও বিশ্লেষণ করছে।
একজন তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, “ঘটনার আগে ও পরে কারা জুবায়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল তা বিশ্লেষণ করছি। মোবাইল ফোন ও সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টও স্ক্যান করা হচ্ছে।”
জুবায়েদের মৃত্যুতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল ও কেন্দ্রীয় ছাত্রদল তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। সোমবার সকাল থেকেই ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের এক নেতা বলেন, “আমরা মনে করি, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যা। জুবায়েদকে রাজনৈতিকভাবে টার্গেট করা হয়েছিল। আমরা দ্রুত বিচার দাবি করছি।”
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও ঘটনাটি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। উপাচার্য অধ্যাপক ড. আজমল হোসেন বলেন, “আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। আশা করছি দ্রুত তদন্তের ফলাফল পাওয়া যাবে।”
আরমানিটোলার পানির পাম্প গলির স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, হত্যার সময় বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে তারা হঠাৎ চিৎকারের শব্দ শুনেছিলেন, কিন্তু কিছু বুঝে উঠতে পারেননি।
একজন দোকানদার বলেন, “আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম কারও ঝগড়া হচ্ছে। পরে দেখি পুলিশ এসেছে। তখন বুঝলাম ভয়ানক কিছু ঘটেছে।”
জুবায়েদের পরিবার কুমিল্লায় বসবাস করেন। ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে তারা ঢাকায় ছুটে আসেন। পরিবারের সদস্যরা কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, জুবায়েদের কোনো শত্রু ছিল না। তিনি শুধু পড়াশোনা ও রাজনীতি নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন।
তার বড় ভাই বলেন, “আমরা ন্যায়বিচার চাই। যেভাবেই হোক খুনিদের ধরতে হবে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ঘটনা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতির নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। জুবায়েদ ছিলেন তরুণ প্রজন্মের সেই রাজনীতিক, যিনি সংগঠন ও শিক্ষাজীবনকে একসঙ্গে সামলাচ্ছিলেন।
একজন বিশ্লেষক মন্তব্য করেন, “যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতারাও নিরাপদ নয়, তখন এটি আমাদের সামগ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যর্থতা প্রকাশ করে।”
ওসি রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, “আমরা আশাবাদী, সিসিটিভির অন্য ফুটেজ ও মোবাইল বিশ্লেষণে দ্রুতই হত্যাকারীদের শনাক্ত করা সম্ভব হবে। ইতোমধ্যে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।”
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, “এই হত্যাকাণ্ড একা কেউ করেনি। এতে দুই থেকে তিনজন জড়িত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।”
ঘটনার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শোকের আবহ ছড়িয়ে পড়ে। সহপাঠী, শিক্ষক ও সংগঠনের নেতাকর্মীরা শ্রদ্ধা জানাতে ক্যাম্পাসে কালো ব্যাজ ধারণ করেন।
পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক ড. নাজমুল আহসান বলেন, “জুবায়েদ খুব শান্ত, মেধাবী ও পরিশ্রমী ছাত্র ছিল। এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।”
জুবায়েদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনেও তীব্র বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কেউ বলছেন এটি ছাত্র রাজনীতির অভ্যন্তরীণ বিরোধ, আবার কেউ দেখছেন এটিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ধারাবাহিকতা হিসেবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, “ঘটনাটি শুধু একটি হত্যাকাণ্ড নয়, এটি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার প্রতীক।”
তদন্ত এগিয়ে চলেছে, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে। পুলিশ বলছে, তারা দ্রুতই চিহ্নিত ব্যক্তিদের ধরতে পারবে।
যদি সিসিটিভিতে দেখা দুই যুবক সত্যিই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকে, তাহলে তাদের ধরতে পারলেই মামলার সমাধান মিলবে
জুবায়েদ হোসাইনের মৃত্যু শুধু একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়; এটি বাংলাদেশে শিক্ষার্থী রাজনীতি ও তরুণ নেতৃত্বের নিরাপত্তা নিয়ে এক গভীর প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
পুরান ঢাকার একটি গলির সিঁড়িতে পড়ে থাকা এক ছাত্রনেতার রক্তাক্ত দেহ যেন আজও চিৎকার করে বলছে—“রাজনীতিতে মানুষ নয়, প্রাণও নিরাপদ নয়।”