ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি তাদের শীর্ষ দুই নেত্রী—চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দুটি বুলেটপ্রুফ গাড়ি কেনার উদ্যোগ নিয়েছে। নির্বাচনকালীন প্রচারণা ও দেশব্যাপী জনসংযোগ কার্যক্রমে এই দুই নেতার নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দলটিকে এ ধরনের যানবাহন কেনার অনুমতি দিয়েছে। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জুন মাসে প্রথম অনুমতি দেওয়া হয় একটি বুলেটপ্রুফ গাড়ি কেনার জন্য এবং অক্টোবরের শুরুতে দেওয়া হয় একটি বুলেটপ্রুফ বাস কেনার অনুমতি। বিএনপি এখনো কোন দেশ থেকে কোন মডেলের গাড়ি কিনবে তা চূড়ান্ত করেনি, তবে দলীয় সূত্রে জানা গেছে, জাপান থেকে গাড়ি আমদানির বিষয়ে আলোচনা চলছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর বলেন, আসন্ন নির্বাচনে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান সারা দেশে জনসংযোগ ও প্রচারণায় অংশ নেবেন। তাঁরা মানুষের সঙ্গে সরাসরি মেলামেশা করবেন, সভা-সমাবেশ ও গণসংযোগ করবেন। একদিকে জনসম্পৃক্ততা বজায় রাখা, অন্যদিকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা—এই দুই বিষয় বিবেচনায় রেখে বুলেটপ্রুফ গাড়ি কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাঁর ভাষায়, “এটি শুধু বিলাসিতা নয়, বরং সময়োপযোগী নিরাপত্তা ব্যবস্থা।” বিএনপি সূত্রে জানা যায়, দলের কোষাধ্যক্ষ এম রশিদুজ্জামান মিল্লাত গত জুন মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি আবেদন করেন, যাতে খালেদা জিয়া ও তাঁর পরিবারের সার্বক্ষণিক ব্যবহারের জন্য একটি বুলেটপ্রুফ গাড়ি কেনার অনুমতি চাওয়া হয়। পরবর্তীতে দলের পক্ষ থেকে আরও একটি বুলেটপ্রুফ বাস আমদানির অনুমতি চাওয়া হয়, যা মূলত খালেদা জিয়া ও দলের শীর্ষ নেতাদের নির্বাচনী ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত হবে। মন্ত্রণালয়ের দুটি সূত্র জানিয়েছে, অনুমতি দেওয়ার আগে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দেয়। সেখানে বলা হয়, আসন্ন নির্বাচনে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান দেশজুড়ে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেবেন। তাদের নিরাপত্তা হুমকি মূল্যায়নে দেখা গেছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের কিছু নেতাকর্মী অথবা বিদেশি এজেন্টদের পক্ষ থেকে হামলার আশঙ্কা রয়েছে। এসব দিক বিবেচনায় এসবি বুলেটপ্রুফ গাড়ি কেনার বিষয়ে অনাপত্তি জানায় এবং নিরাপত্তাজনিত প্রয়োজনে মন্ত্রণালয় অনুমতি প্রদান করে। বাংলাদেশে সাধারণত বুলেটপ্রুফ গাড়ির অনুমতি দেওয়া হয় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, বিদেশি দূতাবাস, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের ব্যবহারের জন্য। রাজনৈতিক দলের জন্য এ ধরনের অনুমতি অতীতে খুব কমই দেওয়া হয়েছে। এজন্য বিএনপিকে এই অনুমতি দেওয়া একটি নজিরবিহীন ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে। রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানিকারক সংগঠন বারভিডা সূত্রে জানা যায়, বুলেটপ্রুফ গাড়ি সাধারণত জাপান, কানাডা ও জার্মানিতে তৈরি হয়। বারভিডার সভাপতি আবদুল হক বলেন, বাংলাদেশে আগে জাপান ও কানাডা থেকে এ ধরনের গাড়ি আনা হয়েছে। শেখ হাসিনার জন্য নব্বইয়ের দশকে জাপান থেকে বুলেটপ্রুফ গাড়ি আনা হয়েছিল এবং পরে কানাডায় সেটি কনভার্সন করা হয়। তিনি আরও জানান, বেসরকারিভাবে বুলেটপ্রুফ গাড়ি আমদানি করা প্রায় অসম্ভব। সরকারিভাবে অনুমতি ছাড়া এ ধরনের গাড়ি আনা যায় না। একটি বুলেটপ্রুফ গাড়ির দাম গড়ে দুই লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় দুই কোটি ৪৪ লাখ টাকা। কিন্তু ৮০০ শতাংশ শুল্কসহ আনলে খরচ দাঁড়াবে প্রায় ২২ কোটি টাকা। বিএনপির সূত্রে জানা যায়, দলের আর্থিক ব্যবস্থাপনা ইউনিট এই অর্থায়নের পরিকল্পনা করছে দলের নির্বাচনকালীন ফান্ড থেকে। বুলেটপ্রুফ গাড়ির পাশাপাশি বিএনপি আরও একটি পদক্ষেপ নিয়েছে তাদের শীর্ষ নেতাদের নিরাপত্তা জোরদার করতে। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দলটি একটি শটগান ও দুটি পিস্তলের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছে, যা বর্তমানে বিবেচনাধীন। এসবি-র নিরাপত্তা মূল্যায়ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এবং প্রতিশোধমূলক হামলার সম্ভাবনা রয়েছে। খালেদা জিয়া, তারেক রহমান এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যরা জনসভা, রোডমার্চ ও অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেবেন, যেখানে তাঁদের প্রাণনাশের ঝুঁকি বিদ্যমান। তাই সার্বক্ষণিক ব্যবহারের জন্য বুলেটপ্রুফ গাড়ির প্রয়োজনীয়তা যৌক্তিক। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, “দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় খালেদা জিয়া ও তাঁর পরিবারের নিরাপত্তা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। বিএনপির নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন জনসমাগম ও প্রচারণা বৃদ্ধি পেলে শত্রুভাবাপন্ন শক্তি হামলার চেষ্টা করতে পারে।” ২০১৫ সালে ঢাকায় তাবিথ আউয়ালের মেয়র নির্বাচনের সময় খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ঘটনাও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। সেবার তাঁর গাড়িসহ চারটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়, যা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দ্বারা সংঘটিত বলে অভিযোগ ওঠে। সেই ঘটনার পর থেকেই বিএনপি চেয়ারপারসনের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। বর্তমানে খালেদা জিয়ার নিজস্ব নিরাপত্তা ইউনিট রয়েছে—চেয়ারপারসন সিকিউরিটি ফোর্স (সিএসএফ)। এই বাহিনীর সদস্যরা সবসময় তাঁর নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকে। দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নিরাপত্তা বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। কারণ, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ায় তাদের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া বা প্রতিশোধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে। পুলিশের একটি অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক গোষ্ঠী বা তাদের সহযোগীরা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব বিশেষ নিরাপত্তা ছাড়া গণসংযোগে নামলে অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটতে পারে। অন্যদিকে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, তিনি দ্রুতই দেশে ফিরে নির্বাচনে অংশ নেবেন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করবেন। দলীয় সূত্র বলছে, তারেক রহমানের দেশে না ফেরার অন্যতম কারণ ছিল নিরাপত্তা সংকট। কিন্তু এবারের নির্বাচনে তাঁকে মাঠে আনতে চায় বিএনপি, এজন্যই নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। দলীয় পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এই অনুমতি বিএনপির জন্য একটি রাজনৈতিক স্বস্তি বয়ে এনেছে। কারণ, বুলেটপ্রুফ গাড়ির অনুমতি পাওয়ার অর্থ হলো সরকারের পক্ষ থেকেও তাদের নির্বাচনী প্রচারে সরাসরি বাধা না দেওয়ার ইঙ্গিত। একই সঙ্গে এটি রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রেও এক নতুন বাস্তবতা তৈরি করছে। অতীতে আওয়ামী লীগ সরকারে থাকাকালে বিএনপির নেতারা রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিচালনায় বিভিন্ন বাধার অভিযোগ তুলেছিলেন। এখন, বিএনপি যখন নির্বাচনী ময়দানে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন তাদের শীর্ষ নেতৃত্বের নিরাপত্তায় এমন অনুমতি সরকারের একটি ইতিবাচক বার্তা বহন করছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত। বাংলাদেশে বুলেটপ্রুফ গাড়ির ইতিহাস খুব দীর্ঘ নয়। নব্বইয়ের দশকে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার জন্যই প্রথম এ ধরনের গাড়ি আনা হয়। পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর আবারও শেখ হাসিনার জন্য নতুন বুলেটপ্রুফ গাড়ি আমদানি করা হয়। তবে বিএনপির ক্ষেত্রে এবারই প্রথম একসঙ্গে দুটি বুলেটপ্রুফ গাড়ির অনুমতি দেওয়া হলো। এটি দলের প্রতি আস্থার একটি নিদর্শন হিসেবেও দেখা হচ্ছে। বিএনপি এখন এই গাড়ি আমদানির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে জাপান, কানাডা ও জার্মানির গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করছে। বারভিডা বলছে, এ ধরনের গাড়ি সাধারণত টয়োটা, বিএমডব্লিউ ও মেরসিডিজ ব্র্যান্ডের হয়ে থাকে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সিদ্ধান্ত শুধু নিরাপত্তা ব্যবস্থা নয়, বরং বিএনপির নির্বাচনী কৌশলের অংশও হতে পারে। কারণ, নিরাপত্তা নিশ্চয়তা ছাড়া বিএনপি নেতৃত্ব নির্বাচনী ময়দানে সক্রিয় হতে চাইবে না। অতীতে নিরাপত্তাজনিত কারণে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান অনেক সময় গণসমাবেশে অংশ নেননি। এবার নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে সফল করতে দলটি যেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে, তা থেকে বোঝা যায়, তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি সংগঠিত এবং কৌশলগতভাবে প্রস্তুত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিএনপির আবেদনের পর বিষয়টি বিভিন্ন দপ্তরের নিরাপত্তা মূল্যায়নের ভিত্তিতে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। একটি উচ্চ পর্যায়ের সভায় আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে, নির্বাচনী সময়কালে বিএনপি নেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের অংশ। কর্মকর্তারা বলেছেন, “নির্বাচনের সময় যে কেউ টার্গেট হতে পারে। আমরা কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাত নয়, বরং নিরাপত্তা নীতির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ক্রমেই উত্তপ্ত হচ্ছে। নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মাঠে নামার প্রস্তুতিও তত বাড়ছে। বিএনপি এবার আগেভাগেই তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে প্রচারণায় মনোযোগ দিতে চাইছে। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নেতৃত্বে নির্বাচনী জনসংযোগ কার্যক্রম শুরুর আগেই এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন দলটির জন্য একটি মনস্তাত্ত্বিক সুবিধা সৃষ্টি করেছে।
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: নাজিম মিয়া
হাদী মিডিয়া, খিলক্ষেত, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত।
ই-মেইল: info@sokolerkantho.com