ফায়ার সার্ভিসের বীরত্বপূর্ণ প্রচেষ্টায় বড় বিপর্যয় এড়ানো গেলো রাজধানীর আকাশদ্বারে
রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শনিবার (১৮ অক্টোবর) দুপুরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। দুপুর আড়াইটার দিকে বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো ভিলেজ হাউসে হঠাৎ করে আগুনের সূত্রপাত ঘটে, যা মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে পুরো কার্গো এলাকায়। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার পরও আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি স্টেশনের ৩৬টি ইউনিট কাজ করে। এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উত্তরা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. মহিদুল ইসলাম, যিনি সম্প্রতি অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পেয়েছেন।
শনিবার দুপুরে বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেট সংলগ্ন কার্গো ভিলেজ এলাকায় ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা যায়। মুহূর্তের মধ্যেই কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায় আকাশ। বিমানবন্দর এলাকায় কর্মরত হাজারো শ্রমিক ও যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে ভয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে শুরু করেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রথমে ওয়ারহাউসের একটি অংশ থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেখানে প্রচণ্ড আগুনের লেলিহান শিখা দেখা দেয়। ফায়ার সার্ভিসে খবর দেওয়া হলে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে দমকল বাহিনীর সদস্যরা।
আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের অন্তত ১৩টি স্টেশন থেকে ৩৬টি ইউনিট অংশ নেয়। এ ছাড়া বিমানবন্দর বাহিনীর নিজস্ব দমকল ইউনিট, র্যাব, পুলিশ, সেনাবাহিনী, আনসার ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও সমন্বিতভাবে কাজ করেন। আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় এগিয়ে এসে আহত হন অন্তত ১০ জন, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই ফায়ার সার্ভিস কর্মী। আহতদের তাৎক্ষণিকভাবে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়।
ডিসি মহিদুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “আহতদের প্রায় সবাই ফায়ার সার্ভিসের সদস্য। তাঁরা আগুন নেভাতে গিয়ে ধোঁয়ার প্রভাবে ও গরমে আহত হয়েছেন। দ্রুত তাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে এবং সবার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল।”
অগ্নিকাণ্ডের পর বিমানবন্দর এলাকায় বিশাল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়। ডিসি মহিদুল ইসলাম জানান, “অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে প্রায় ৫ হাজার সদস্য এখানে দায়িত্ব পালন করছেন। সেনাবাহিনী, র্যাব, বিমানবাহিনী, পুলিশ, আনসার এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা একসাথে কাজ করছেন।”
তিনি আরও বলেন, “প্রাথমিকভাবে আগুন কার্গো ভিলেজের ওয়ারহাউস অংশে লাগে। পরে দ্রুত তা পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। আগুনের উৎস এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে বিস্ফোরণ বা কোনো ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের প্রমাণ এখন পর্যন্ত মেলেনি।”
আগুন লাগা কার্গো ভিলেজে আমদানি পণ্যের বিশাল মজুদ ছিল বলে জানা গেছে। প্রাথমিকভাবে কয়েকশ কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। অনেক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও এয়ারলাইনসের সংরক্ষিত পণ্য সেখানে ছিল। আগুনের তীব্রতায় প্যাকেজ, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, পোশাক, কসমেটিকস, এমনকি কিছু রপ্তানিযোগ্য পণ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা ধারণা করছি, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। কারণ, আগুন লাগার ঠিক আগে বিদ্যুতের লাইন থেকে স্পার্ক দেখা গিয়েছিল। তদন্তের পর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।”
অগ্নিকাণ্ডের ফলে দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত বিমানবন্দরের কার্গো সেবা কার্যক্রম বন্ধ থাকে। তবে যাত্রীবাহী ফ্লাইটের কার্যক্রম স্বাভাবিক ছিল বলে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। কার্গো এলাকার প্রবেশপথে কয়েক ঘণ্টা যানজট সৃষ্টি হয়। নিরাপত্তার স্বার্থে ৮ নম্বর গেট সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়।
ঢাকা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মুহাম্মদ খায়রুল কবির সাংবাদিকদের বলেন, “আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে আমরা জরুরি সাড়া ব্যবস্থা সক্রিয় করি। যাত্রী পরিবহন কার্যক্রম বন্ধ হয়নি। তবে কার্গো এলাকায় প্রবেশ সাময়িকভাবে স্থগিত ছিল। এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে।”
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে আসলেও আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে হয়। ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর থেকে পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল তৌফিকুল ইসলাম জানান, “আমাদের ৩৬টি ইউনিট কাজ করছে। আগুনের বিস্তার রোধ করা গেছে, তবে ভেতরে প্রচুর দাহ্য বস্তু থাকায় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লাগছে।”
অগ্নিকাণ্ডের পর স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন, রেড ক্রিসেন্ট, ওয়াসা, এমনকি বিমানবন্দরের দোকান মালিক সমিতির সদস্যরাও সহায়তায় এগিয়ে আসেন। ওয়াসার কয়েকটি গাড়ি পানি সরবরাহ করে ফায়ার সার্ভিসকে সহযোগিতা করে। আহতদের মধ্যে কয়েকজনের চিকিৎসা খরচ বহনের ঘোষণা দিয়েছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং দ্রুত উদ্ধার ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদারের নির্দেশ দিয়েছেন বলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে। বিমান প্রতিমন্ত্রী ফারুক আহমেদ খান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের বলেন, “এটি একটি বড় দুর্ঘটনা হতে পারত। ফায়ার সার্ভিস ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর দ্রুত পদক্ষেপে বড় বিপর্যয় এড়ানো গেছে।”
অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে তিনটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক), ফায়ার সার্ভিস ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ নিজ নিজ তদন্ত শুরু করেছে। প্রাথমিকভাবে বৈদ্যুতিক ত্রুটি বা অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার ঘাটতি এ দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
আগুন নেভানোর পর বিমানবন্দরের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘিরে চলছে পুনরুদ্ধার কার্যক্রম। কর্মীরা ধ্বংসস্তূপ থেকে মালামাল উদ্ধার করছেন। আহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও বেবিচক। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার ঘাটতি চিহ্নিত করে দ্রুত তা আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। সেখানে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড শুধু আর্থিক ক্ষতির কারণ নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তার দিক থেকেও বড় সতর্ক সংকেত। অগ্নি প্রতিরোধ ব্যবস্থা কতটা কার্যকর এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার—তা এখনই গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সাহসিকতা ও সমন্বিত উদ্ধার কার্যক্রম না হলে এই অগ্নিকাণ্ড আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারত।