সনদহীন ভবনে শিল্প, প্রশাসনের চোখে অব্যবস্থাপনার আগুন
চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (সিইপিজেড) — দেশের অন্যতম রপ্তানিমুখী শিল্প এলাকা। এখানে হাজারো শ্রমিক প্রতিদিন ঘাম ঝরান বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে। অথচ, এমনই এক শিল্পভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, যার অগ্নিনিরাপত্তা সনদই ছিল না।
ফলে একটি দুর্ঘটনা এক মুহূর্তেই পরিণত হয়েছে ধ্বংসযজ্ঞে—দুটি প্রতিষ্ঠান পুড়ে ছাই, কোটি টাকার ক্ষতি, শ্রমিকদের জীবনে আতঙ্কের ছাপ, আর প্রশাসনের অবহেলার মুখোশ খুলে গেছে নতুন করে।
ঘটনাটি ঘটেছে বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর দুপুর আড়াইটার দিকে।
সিইপিজেডের ১ নম্বর সেক্টরের ৫ নম্বর সড়কে অবস্থিত একটি আটতলা ভবনের সাততলায় আগুনের সূত্রপাত হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আগুন পুরো তলায় ছড়িয়ে পড়ে। ভবনটিতে ছিল দুটি প্রতিষ্ঠান—অ্যাডামস ক্যাপ অ্যান্ড টেক্সটাইল লিমিটেড এবং জিহং মেডিকেল কোম্পানি।
দুটি প্রতিষ্ঠানই ছিল রপ্তানিমুখী। একটিতে টাওয়েল ও ক্যাপ, অন্যটিতে সার্জিক্যাল গাউন ও চিকিৎসা সরঞ্জাম তৈরি হতো। গুদামে থাকা এসব দাহ্য পদার্থ আগুনের তীব্রতা বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে।
চোখের পলকে সাদা ধোঁয়া ও আগুনে ঢেকে যায় গোটা ভবন। কর্মীরা চিৎকার করে ছুটে বেরিয়ে আসতে থাকে। কেউ জানালা দিয়ে লাফ দেয়, কেউ প্রাণ বাঁচাতে ভেতরেই আটকা পড়ে যায়।
খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটগুলো ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়।
পরিস্থিতি ভয়াবহ দেখে পরে যোগ দেয় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিজিবি।
তবে আগুনের ব্যাপকতা এমন ছিল যে, রাত ১০টার পরও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি।
ফায়ার সার্ভিসের ১৭টি ইউনিট টানা ১৭ ঘণ্টা কাজ করে শুক্রবার সকাল ৭টা ২৫ মিনিটে আগুন “নিয়ন্ত্রণে এসেছে” বলে জানায়। ততক্ষণে ভবনের কিছু অংশ ধসে পড়ে, আশপাশের ভবনগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
স্থানীয়রা জানান, “আগুনের তাপে কয়েকশো মিটার দূরেও দাঁড়ানো যাচ্ছিল না।” এমনকি রাতের বৃষ্টিও আগুন নেভাতে পারেনি।
শুক্রবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেনেন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন,
“ভবনটির কোনো অগ্নিনিরাপত্তা সনদ ছিল না। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ আবেদন করেছিল, কিন্তু আমরা এখনো পরিদর্শন করতে পারিনি। তার আগেই দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।”
তিনি আরও জানান,
“ভবনের দুই পাশে পর্যাপ্ত জায়গা রাখা হয়নি। ফলে আগুন নেভানোর গাড়ি ঢুকতে পারেনি। দুই পাশ বন্ধ থাকায় সামনের দিক দিয়েই আমরা আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করি।”
এই বক্তব্যে স্পষ্ট—একটি সরকারি শিল্পাঞ্চল, যেখানে নিরাপত্তা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কথা, সেখানেই নিয়ম ভঙ্গ করে ভবন চালু করা হয়েছিল।
তদন্তে জানা গেছে, ভবনটি আটতলা বিশিষ্ট, যার নকশায় একাধিক নিরাপত্তা মানদণ্ড মানার কথা ছিল—
- পর্যাপ্ত খোলা স্থান রাখতে হতো দুই পাশে,
- জরুরি নির্গমন সিঁড়ি থাকতে হতো প্রতিটি তলায়,
- ফায়ার অ্যালার্ম ও স্প্রিংকলার সিস্টেম বাধ্যতামূলক ছিল,
- এবং উৎপাদন শুরু করার আগে অগ্নিনিরাপত্তা সনদ সংগ্রহ করতে হতো।
কিন্তু বাস্তবে এই নিয়মগুলো ছিল শুধুই কাগজে।
পরিদর্শন না হওয়া ভবনে উৎপাদন শুরু হয়েছিল, গুদামে রাখা হয়েছিল শত শত টন কাপড় ও রাসায়নিক পদার্থ।
ফলাফল? এক ভয়াবহ বিস্ফোরক পরিস্থিতি—যা বৃহস্পতিবার বিকেলে আগুনে রূপ নেয়।
আগুন লাগার সময় শতাধিক শ্রমিক ভবনের ভেতরে ছিলেন।
তাদের একজন, হাসিনা বেগম, বলেন—
“আমরা কাজ করছিলাম, হঠাৎ দেখি ধোঁয়া উঠছে। অ্যালার্ম বাজেনি। সবাই দৌড় দিলাম। অনেকে জিনিস নিতে পারেনি, কেউ কেউ ধোঁয়ায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল।”
অন্য শ্রমিক রুবেল মিয়া জানান,
“গুদামের ভিতরে অনেক কাপড়, কেমিক্যাল রাখা ছিল। আগুন এত দ্রুত ছড়িয়েছে যে ৫ মিনিটের মধ্যে পুরো তলা জ্বলতে থাকে।”
শ্রমিকদের দাবি, বারবার অনুরোধ করার পরও কারখানার অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক করা হয়নি। কর্তৃপক্ষ বলেছিল, “সব ঠিক আছে, সনদ প্রক্রিয়াধীন।”
প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী—
- অ্যাডামস ক্যাপ অ্যান্ড টেক্সটাইলের পুরো গুদাম ও যন্ত্রপাতি পুড়ে গেছে।
- জিহং মেডিকেল কোম্পানির চিকিৎসা সরঞ্জাম ও কাঁচামাল ধ্বংস হয়েছে।
- ভবনের অভ্যন্তরীণ কাঠামো ভস্মীভূত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতির পরিমাণ কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকার বেশি।
এছাড়া শতাধিক শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।
ফায়ার সার্ভিস বলেছে,
“আমরা এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি আগুনের উৎস কী ছিল। ধারণা করা হচ্ছে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট, অথবা গুদামের দাহ্য পদার্থ থেকেই আগুনের সূত্রপাত।”
একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে ফায়ার সার্ভিস, বিইপিজেড কর্তৃপক্ষ ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা রয়েছেন। কমিটিকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে প্রাথমিক প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ শ্রম আইন ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (BNBC) অনুযায়ী,
“যে কোনো শিল্প ভবনে উৎপাদন শুরু করার আগে ফায়ার সার্ভিস থেকে অগ্নিনিরাপত্তা সনদ নেওয়া বাধ্যতামূলক।”
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়,
- অনেক প্রতিষ্ঠান শুধু আবেদন করে;
- পরিদর্শন ছাড়াই উৎপাদন শুরু করে দেয়;
- এবং বছরের পর বছর ধরে ‘প্রক্রিয়াধীন’ সনদ দেখিয়ে চলে।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৫০ হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ১৫ হাজারের বৈধ অগ্নিনিরাপত্তা সনদ রয়েছে।
অন্যরা এখনো “প্রক্রিয়াধীন”—অর্থাৎ অরক্ষিত অবস্থায় পরিচালিত হচ্ছে।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন,
“আমরা নিয়মিত পরিদর্শন করতে চাই, কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠান প্রবেশাধিকার দেয় না বা অনুমতি নিতে সময় নেয়। ইপিজেডের মতো এলাকায় এসব বিষয় নিয়ে আরও কঠোর হওয়া দরকার।”
অন্যদিকে, সিইপিজেড কর্তৃপক্ষ জানায়,
“আমরা প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নথি যাচাই করছি। ভবিষ্যতে কোনো প্রতিষ্ঠান সনদ ছাড়া উৎপাদন করতে পারবে না।”
তবে বাস্তবে প্রশাসনিক তদারকি যতদিন কাগজে সীমাবদ্ধ থাকবে, ততদিন এ ধরনের দুর্ঘটনা অব্যাহত থাকবে—এমন মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে এখনো ‘ফায়ার সেফটি কালচার’ প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসকে ফোন করে, কিন্তু আগুন লাগার আগেই আগুন প্রতিরোধের চিন্তা করে না।
- প্রতি ৬ মাসে ফায়ার ড্রিল ও প্রশিক্ষণ
- স্প্রিংকলার ও হাইড্রেন্ট পরীক্ষা
- জরুরি নির্গমন পথ খোলা রাখা
- শ্রমিকদের অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি
- নিয়মিত ফায়ার সনদ নবায়ন
এগুলো বাস্তবায়ন না হলে, সিইপিজেডের আগুন কেবল এক দিনের ঘটনা নয়, এটি ভবিষ্যতের বার্তা হয়ে থাকবে।
চট্টগ্রাম ইপিজেড থেকে প্রতি বছর কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশের পোশাক ও চিকিৎসা সামগ্রীর বড় অংশ এখান থেকেই নেয়।
এমন দুর্ঘটনা আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থায় আঘাত হানে।
বিজিএমইএ এক বিবৃতিতে বলেছে—
“এই দুর্ঘটনা দেশের রপ্তানি ইমেজের ওপর প্রভাব ফেলবে। আমরা চাই, ভবিষ্যতে প্রতিটি কারখানা বাধ্যতামূলকভাবে অগ্নিনিরাপত্তা মানদণ্ড পূরণ করুক।”
স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বাসিন্দারা বলছেন, ভবনের আশপাশে আগে থেকেই সংকীর্ণ রাস্তা এবং পানি সরবরাহের সমস্যা ছিল।
একজন ব্যবসায়ী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন—
“এখানে জায়গা না রেখেই ভবন উঠানো হয়েছে। সবাই জানত, একদিন বড় দুর্ঘটনা হবেই।”
তাদের অভিযোগ, বারবার সতর্ক করা হলেও কেউ শোনেনি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. মজিবুর রহমান বলেন—
“একটি সরকারি শিল্পাঞ্চলে সনদবিহীন ভবন কীভাবে কার্যক্রম চালায়, সেটাই বড় প্রশ্ন। এটি শুধু ভবন মালিকের নয়, প্রশাসনেরও ব্যর্থতা।”
তিনি আরও বলেন—
“বাংলাদেশ এখন রপ্তানি নির্ভর অর্থনীতি। এই ধরনের অব্যবস্থাপনা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থায় আঘাত হানবে।”
সরকার এখন চায়, প্রতিটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে আসুক।
অগ্নিনিরাপত্তা সনদ ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করলে তা অবিলম্বে বন্ধ করে দেওয়া হবে।
ফায়ার সার্ভিস ইতিমধ্যে নতুন ডিজিটাল সনদ ব্যবস্থা চালু করেছে, যাতে জাল নথির সুযোগ না থাকে।
চট্টগ্রাম ইপিজেডের আগুন এক দিনের নয়, এটি বছরের পর বছর ধরে গড়ে ওঠা অবহেলা ও উদাসীনতার প্রতিফলন।
অগ্নিনিরাপত্তা সনদ ছাড়া একটি ভবন চলছিল, কর্তৃপক্ষ জানত, শ্রমিকরা ভয় পেত, কিন্তু কেউ থামায়নি।
আজ আগুন নিভেছে, ধোঁয়া মিলিয়ে গেছে, কিন্তু বাতাসে রয়ে গেছে প্রশ্ন—
“একটি সনদ যদি জীবন বাঁচাতে পারে, তবে কেন আমরা সেটি নিতে এত দেরি করি?”
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করাই এখন সময়ের দাবি।