ডেস্ক রিপোর্ট | সকলের কণ্ঠ
বাংলাদেশে বর্তমানে জন্মনিবন্ধনের হার প্রায় ৫০ শতাংশ এবং মৃত্যু নিবন্ধনের হার ৪৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন নিশ্চিত করার লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করলেও বাস্তবে তা অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যমান আইনের দুর্বলতা, প্রক্রিয়াগত জটিলতা, জনবল সংকট ও জনসচেতনতার অভাব এই লক্ষ্য পূরণের পথে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান নিচের সারিতে
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ জন্মনিবন্ধনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। মালদ্বীপ, ভুটান ও শ্রীলঙ্কায় জন্মনিবন্ধনের হার প্রায় শতভাগে পৌঁছেছে। ভারত ৮৯ দশমিক ০১ শতাংশ, নেপাল ৭৭ শতাংশ এবং মিয়ানমার ৮১ দশমিক ৩ শতাংশ জন্মনিবন্ধন সম্পন্ন করেছে। অথচ বাংলাদেশ এখনো অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে নিবন্ধনের আওতায় আনতে পারেনি। ফলে আঞ্চলিক তুলনায় দেশটি অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সময়মতো জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন না হওয়ায় দেশের জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পরিসংখ্যান বিকৃত হচ্ছে। এর ফলে সরকারি পরিকল্পনা, উন্নয়ন বাজেট এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি প্রণয়নে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।
জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন শুধু নাগরিক অধিকার নয়, উন্নয়নের ভিত্তিও
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কেবল একজন নাগরিকের পরিচয় নিশ্চিত করার মাধ্যম নয়; এটি রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়নের অন্যতম ভিত্তি। নিবন্ধিত তথ্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, সম্পত্তির উত্তরাধিকার, ভোটাধিকার এবং নাগরিক পরিচয় নিশ্চিত করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। একই সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ে বাজেট পরিকল্পনা, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এই নিবন্ধন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) বাংলাদেশ কান্ট্রি লিড মুহাম্মাদ রূহুল কুদ্দুস বলেন, “জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। এটি সঠিক জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্য তথ্য সংরক্ষণ, বাজেট প্রণয়ন এবং রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।”
তিনি আরও বলেন, “বর্তমান আইনে জন্ম ও মৃত্যুর তথ্য প্রদানের দায়িত্ব পরিবারকে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগের ভূমিকা ঐচ্ছিক রাখা হয়েছে। দেশে প্রায় ৬৭ শতাংশ শিশু বর্তমানে হাসপাতালে জন্ম নিচ্ছে, তবুও পরিবারকে আলাদাভাবে নিবন্ধন করতে হয়। অনেক সময় মানুষ সচেতনতার অভাবে বা প্রক্রিয়াগত জটিলতায় নিবন্ধন করে না, যার ফলে জাতীয় পরিসংখ্যান বিকৃত হয়।”
স্বাস্থ্যখাতের সঙ্গে দুর্বল সমন্বয় বড় প্রতিবন্ধকতা
মুহাম্মাদ রূহুল কুদ্দুস মনে করেন, হাসপাতালগুলোকে আইনগতভাবে নিবন্ধনের দায়িত্ব দিলে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের হার দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। তিনি বলেন, “স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোকে দায়িত্ব দিলে নবজাতকরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিবন্ধনের আওতায় আসবে। এতে পরিবারকে আলাদা করে কোনো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে না।”
তিনি উদাহরণ হিসেবে জানান, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অনেক দেশ হাসপাতালভিত্তিক নিবন্ধন ব্যবস্থা চালু করে শতভাগ বা তার কাছাকাছি হার অর্জন করেছে। তাই বাংলাদেশেও এই মডেল অনুসরণ করলে সফলতা আসবে।
রূহুল কুদ্দুস আরও বলেন, “শতভাগ জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য দ্রুত আইন সংশোধন করা জরুরি। স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোকে আইনগতভাবে দায়িত্ব দিলে শুধু নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ হবে না, বরং এসডিজির লক্ষ্য—সবার জন্য বৈধ পরিচয়পত্র প্রদান—অর্জনেও সহায়ক হবে।”
আইন সংশোধনের দাবি বিশেষজ্ঞদের
ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিসের কান্ট্রি কোঅর্ডিনেটর মো. নজরুল ইসলাম বলেন, “জাতিসংঘের আঞ্চলিক সংস্থা ইউএনএসকাপ ঘোষিত সিভিল রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস (সিআরভিএস) কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু এ লক্ষ্য পূরণ করতে হলে ২০০৪ সালের নিবন্ধন আইনটি সংশোধন করতে হবে।”
তিনি মনে করেন, প্রযুক্তিগত অবকাঠামো উন্নয়ন, পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ ও স্থানীয় প্রশাসনের সক্ষমতা বাড়ানো ছাড়া এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়।
প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, “বিদ্যমান আইন সংশোধন না করলে বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে পিছিয়ে পড়বে। জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনকে ঐচ্ছিক না রেখে আইনগত বাধ্যবাধকতা তৈরি করা সময়ের দাবি।”
তিনি আরও বলেন, “বিশ্বজুড়ে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। ২০০০ সালে বিশ্বে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের জন্মনিবন্ধনের হার ছিল ৬০ শতাংশ। ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালে তা বেড়ে ৭৭ শতাংশে পৌঁছেছে। তবুও বিশ্বে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন শিশু এখনো অনিবন্ধিত।”
বৈশ্বিক অগ্রগতি, বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে
ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে প্রায় শতভাগ জন্মনিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে। ইউএনএসকাপের তথ্য অনুযায়ী, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও গত এক দশকে জন্মনিবন্ধনে বিশাল অগ্রগতি হয়েছে। ২০১২ সালে যেখানে পাঁচ বছরের নিচে অনিবন্ধিত শিশুর সংখ্যা ছিল ১৩৫ মিলিয়ন, বর্তমানে তা কমে ৫১ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে।
তবে এখনো প্রতি বছর প্রায় ১৪ মিলিয়ন শিশু জন্মের এক বছরের মধ্যে নিবন্ধিত হয় না। অন্যদিকে, ২০২৩ সালে মৃত্যু নিবন্ধনের বৈশ্বিক গড় হার ৭৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজেশন এবং স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দ্রুত অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোতে নিবন্ধন কার্যক্রম আরও সহজ করা এবং অনলাইন নিবন্ধন ব্যবস্থা জনগণের নাগালে পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন।
নিবন্ধনের অভাবে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় বাধা
জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের ঘাটতি শুধু নাগরিক পরিচয় নয়, রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কারণ সঠিক জনসংখ্যা ও মৃত্যু পরিসংখ্যান না থাকলে বাজেট পরিকল্পনা, স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ এবং শিক্ষা খাতের ভবিষ্যৎ চাহিদা নির্ধারণে সমস্যা দেখা দেয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একটি শিশুর জন্মনিবন্ধন না হলে সে রাষ্ট্রীয় সেবার বাইরে থেকে যায়। ভবিষ্যতে স্কুলে ভর্তি, ভোটাধিকার বা পাসপোর্ট প্রাপ্তিতেও সমস্যা দেখা দেয়। একইভাবে মৃত্যু নিবন্ধন না থাকলে পরিবার সম্পত্তি উত্তরাধিকার কিংবা সরকারি সহায়তা গ্রহণে আইনি জটিলতায় পড়ে।
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, সহজ প্রক্রিয়া ও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে নিবন্ধনের হার দ্রুত বাড়বে। পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে রিয়েল টাইম ডেটা আপডেটের ব্যবস্থা চালু করা গেলে সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগিতায় ইতোমধ্যে কিছু এলাকায় অনলাইন নিবন্ধন পাইলট প্রকল্প চালু হয়েছে। এই উদ্যোগকে সারাদেশে সম্প্রসারণের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা আরও বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সরকার ও স্বাস্থ্য খাতের মধ্যে সমন্বয় জোরদার করা গেলে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন একটি টেকসই কাঠামোর মধ্যে আনা সম্ভব হবে।