স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়ে ইতিহাস গড়লেন ‘গণঅভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলন’-এর আহ্বায়ক আব্দুর রশিদ জিতু
বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষার্থীদের সংগঠন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আয়োজিত এই নির্বাচনে সবচেয়ে আলোচিত পদ সহ-সভাপতি (ভিপি) হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুর রশিদ জিতু। তিনি বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচিত সংগঠন ‘গণঅভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলন’-এর আহ্বায়ক।
শনিবার (তারিখ) আনুষ্ঠানিকভাবে জিতুর নাম ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মো. মনিরুজ্জামান। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাঙ্গনে নতুন এক রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে।
আব্দুর রশিদ জিতু একসময় ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় তিনি ছাত্রলীগের হাতে প্রথম হামলার শিকার হন। সেখান থেকেই মূলত তার নতুন রাজনৈতিক যাত্রার সূচনা।
- আরিফ সোহেল আটক হলে তিনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।
- ৫ আগস্ট পর্যন্ত ফার্স্ট ম্যান হিসেবে আন্দোলন পরিচালনা করেন।
- পরবর্তীতে তিনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক পদ থেকে পদত্যাগ করে নতুন প্ল্যাটফর্ম ‘গণঅভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলন’ গঠন করেন।
- এই প্ল্যাটফর্ম থেকেই তিনি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন।
তার নেতৃত্বে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা নতুন ধরনের রাজনৈতিক চেতনার স্বাদ পেয়েছে বলে অনেকেই মন্তব্য করছেন।
- মোট ভোটার: ১১,৭৫৯ জন
- ভোট দিয়েছেন: প্রায় ৬৮ শতাংশ শিক্ষার্থী
- নারী ভোটার: ৫,৭২৮ জন
- পুরুষ ভোটার: ৬,১১৫ জন
এবারের নির্বাচনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১টি হলে ভোটগ্রহণ হয়েছে। ২১টি কেন্দ্রে মোট ২২৪টি বুথ স্থাপন করা হয়।
- মোট প্রার্থী: ১৭৭ জন
- ভিপি পদে: ৯ জন
- সাধারণ সম্পাদক (জিএস): ৮ জন
- যুগ্ম সম্পাদক (এজিএস): ১৬ জন
- নারী প্রার্থী: ৬ জন
এছাড়াও নির্বাচনে ৮টি পূর্ণ ও আংশিক প্যানেল অংশ নেয়।
ভোটগ্রহণ শুরুর পরেই কারচুপির অভিযোগ তুলে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলসহ বেশ কয়েকটি প্যানেল নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। বর্জনকারীদের মধ্যে ছিল—
- প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের সম্প্রীতির ঐক্য
- বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র ফ্রন্টের সংশপ্তক পর্ষদ
- স্বতন্ত্রদের অঙ্গীকার পরিষদ
- ছাত্র ফ্রন্টের বিভাজিত অংশ ও কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী
এই বর্জন নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কিছুটা প্রভাব ফেললেও সামগ্রিকভাবে ভোটগ্রহণ সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হয় বলে নির্বাচন কমিশন দাবি করেছে।
আব্দুর রশিদ জিতুর জয়কে অনেক শিক্ষার্থী আন্দোলনমুখী ছাত্ররাজনীতির জয় হিসেবে দেখছেন। তার বিজয়ের পেছনে রয়েছে—
- কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়কার ভূমিকা
- বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব
- স্বাধীন প্ল্যাটফর্ম থেকে শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ
- রাজনীতিতে স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ ইমেজ
বিশ্লেষকদের মতে, এই বিজয় কেবল একটি ব্যক্তির জয় নয়, বরং শিক্ষার্থীদের নতুন রাজনৈতিক দিকনির্দেশনার প্রতীক।
জিতুর বিজয়ের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করা যায়।
- অনেকে মনে করছেন, ক্যাম্পাসের গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় পদক্ষেপ।
- কেউ কেউ বলছেন, দীর্ঘদিন পর শিক্ষার্থীদের ভোটের মাধ্যমে সত্যিকারের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হলো।
- তবে কিছু শিক্ষার্থী আবার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, এই বিজয়ের পরও প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর চাপ অব্যাহত থাকতে পারে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জাকসু নির্বাচন সবসময়ই জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। কারণ—
- এখানে উদ্ভূত আন্দোলনগুলো অনেক সময় জাতীয় পর্যায়ে প্রভাব ফেলেছে।
- শিক্ষার্থীরা এখানে প্রগতিশীল, বামঘেঁষা ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মিশ্রণ ঘটিয়ে অনন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করেছে।
- তাই জাকসু নির্বাচন শুধু শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব নয়, বরং জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা দিতেও ভূমিকা রাখে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন—
- জিতুর জয় নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক চেতনার প্রতিফলন।
- শিক্ষার্থীরা প্রমাণ করেছে, তারা দলীয় রাজনীতির বাইরে থেকেও নেতৃত্ব বেছে নিতে সক্ষম।
- এটি ভবিষ্যতে জাতীয় রাজনীতিতে নতুন নেতৃত্বের উত্থানের ইঙ্গিত দিতে পারে।
আব্দুর রশিদ জিতুর সহ-সভাপতি (ভিপি) হিসেবে বিজয় শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস ও গণতান্ত্রিক চেতনার বড় প্রমাণ। তার এই জয় শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নয়, বরং বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসেও একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে।
এই নির্বাচন দেখিয়ে দিয়েছে—শিক্ষার্থীরা যদি ঐক্যবদ্ধ হয়, তবে স্বতন্ত্র প্ল্যাটফর্ম থেকেও বড় ধরনের পরিবর্তন আনা সম্ভব।