ক্লাসরুমে প্রচারণার অভিযোগে সমালোচনার মুখে শিবির সমর্থিত জিএস প্রার্থী এস এম ফরহাদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রতিদিনই নতুন নতুন বিতর্ক সামনে আসছে। নির্বাচন ঘিরে যেমন ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা তীব্র হচ্ছে, তেমনি প্রার্থীদের আচরণ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। সর্বশেষ আলোচনায় এসেছেন ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদপ্রার্থী এস এম ফরহাদ। অভিযোগ উঠেছে, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে শিক্ষার্থীদের কাছে ভোট প্রার্থনা করেছেন, যা ডাকসুর আচরণবিধির পরিপন্থী।
তবে ফরহাদসহ উপস্থিত শিক্ষার্থীরা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাদের দাবি, তিনি কেবল ক্লাস শুরু হওয়ার আগে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করেছিলেন এবং শিক্ষার্থীদের সালাম দিয়ে বের হয়ে যান। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে শুরু হয়েছে তীব্র আলোচনা-সমালোচনা।
শিবির সমর্থিত প্রার্থী এস এম ফরহাদ এর আগেও আইনি জটিলতার মুখে পড়েছিলেন। তার প্রার্থিতা নিয়ে আদালতে রিট হয়। অভিযোগ ছিল, তিনি ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্রলীগের কমিটিতে যুক্ত ছিলেন। যদিও তিনি এবং তার সমর্থকরা বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। আদালত প্রক্রিয়ার মধ্যেই এবার নতুন বিতর্ক সামনে আসলো— ক্লাসরুমে প্রচারণা চালানোর অভিযোগ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ডাকসুর নির্বাচন ঘিরে স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর ব্যত্যয় ঘটলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।
বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রথম বর্ষের ১০৩ কোর্সের ক্লাসে এই ঘটনাটি ঘটে বলে অভিযোগ উঠেছে।
একদল শিক্ষার্থী দাবি করেন, ফরহাদ কক্ষে প্রবেশ করে সরাসরি ভোট প্রার্থনা করেছেন। তবে সেখানে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের অনেকেই এ অভিযোগ অস্বীকার করেন।
প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার সুপ্ত বলেন—
“ফরহাদ ভাই তখন কোনো প্রচারণা করেননি। তখনো আমাদের ক্লাস শুরু হয়নি। তিনি কক্ষে ঢুকে শুধু সালাম দিয়ে বের হয়ে যান।”
অন্য শিক্ষার্থী সাজিদ জিসানও একই কথা জানান। তার ভাষ্য, “তিনি কারও কাছে ভোট চাননি, লিফলেটও দেননি। শুধু বলেছিলেন, দোয়া করবেন।”
ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন ইনস্টিটিউটের শিক্ষক রনি মৃধা। তিনি জানান—
“আমার ক্লাস শুরুর কথা ছিল সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে। আমি একটু দেরিতে ঢুকি। প্রায় একই সময়ে ফরহাদও কক্ষে আসে। তখনো ক্লাস শুরু হয়নি। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দু-একটা কথা বলে আমাকে ‘সরি’ বলে বের হয়ে যায়। ফলে এ নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।”
শিক্ষকের এই বক্তব্যের পর অনেকেই মনে করছেন, ঘটনাটিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিতর্কিত করা হচ্ছে।
অভিযোগ অস্বীকার করে এস এম ফরহাদ বলেন—
“আমাদের ইনস্টিটিউটের ক্লাসের মাঝে বড় ব্রেক থাকে, তখন শিক্ষার্থীরা আড্ডা দেয়। আমি হাঁটতে হাঁটতে ভেতরে গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা হলে শুধু সালাম দিয়েছি। কাউকে বিরক্ত করিনি, লিফলেট দিইনি, কারও কাছে ভোটও চাইনি। এখন একটি ছবি ব্যবহার করে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।”
তিনি আরও দাবি করেন, তাকে রাজনৈতিকভাবে হেয় করার জন্যই এই বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে।
ডাকসুর আচরণবিধি বিষয়ক টাস্কফোর্সের আহ্বায়ক গোলাম রব্বানী জানিয়েছেন, এখনো পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পাওয়া যায়নি। অভিযোগ এলে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আচরণবিধির ৬(চ) ধারায় বলা আছে—
“শ্রেণিকক্ষ, পাঠকক্ষ বা পরীক্ষার হলে এমন কোনো সভা বা প্রচারণা করা যাবে না, যা পাঠদান বা পরীক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত করতে পারে। এছাড়া শ্রেণিকক্ষ ও করিডোরে মিছিলও নিষিদ্ধ।”
তাই এ ঘটনা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তবে তা আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
ঘটনাটিকে ঘিরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি হয়েছে। একপক্ষ বলছে, ফরহাদ প্রচারণা করেছেন, যা আচরণবিধির বিরোধী। অন্যপক্ষের দাবি, তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে।
একজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করে বলেন—
“ডাকসুর নির্বাচন সবসময় উত্তেজনাপূর্ণ হয়। এবারও ভিন্ন কিছু নয়। প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা স্বাভাবিক। কিন্তু ক্লাসরুমে প্রচারণা হলে সেটা অন্য শিক্ষার্থীদের জন্য বিরক্তিকর।”
অন্যদিকে আরেকজন শিক্ষার্থী বলেন—
“ছবিটা দেখে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে। ফরহাদ ভাই আমাদের সঙ্গে কেবল সালাম দিয়ে বের হয়ে যান। এটাকে প্রচারণা বলা ঠিক হবে না।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু নির্বাচন সবসময়ই জাতীয় রাজনীতির প্রতিফলন হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিটি বড় দল তাদের সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। শিবির সমর্থিত প্যানেল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ফরহাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠায় নির্বাচনের উত্তাপ আরও বেড়ে গেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ফরহাদের বিরুদ্ধে রিট, এরপর প্রচারণার অভিযোগ— সবকিছুই নির্বাচনী কৌশলের অংশ হতে পারে। এতে একদিকে ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়, অন্যদিকে প্রার্থীর ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
শিক্ষার্থী সমাজের অনেকে মনে করছেন, ডাকসুর নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য করতে হলে আচরণবিধি কঠোরভাবে মানতে হবে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলোকেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভূমিকা রাখতে হবে।
ঢাবির একজন সিনিয়র শিক্ষক বলেন—
“ডাকসু শুধু একটি ছাত্র সংসদ নয়, এটি বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির প্রতিচ্ছবি। এখানে অনিয়ম হলে তা দেশের রাজনীতির ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে।”
ডাকসু নির্বাচন ঘিরে উত্তেজনা দিন দিন বাড়ছে। প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ, আচরণবিধি ভঙ্গের বিতর্ক এবং আদালতে রিট— সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে। তবে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নির্বাচনী আচরণবিধি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করবে এবং একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করবে।
এস এম ফরহাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ কতটা সত্য, তা প্রমাণ হবে তদন্তের মাধ্যমে। তবে এ ঘটনা স্পষ্ট করেছে যে, ডাকসু নির্বাচন ঘিরে প্রতিটি পদক্ষেপই এখন শিক্ষার্থীদের নজরে এবং জনমতের আলোচনায়।