কর কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ কেলেঙ্কারি: ৩৮ লাখ টাকার বিনিময়ে কর নথি সরবরাহের অভিযোগ
বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে একটি বড় আলোচনার জন্ম দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত। কর অঞ্চল-৫ এর সহকারী কর কমিশনার জান্নাতুল ফেরদৌস মিতুর বিরুদ্ধে ৩৮ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে সংস্থাটি। সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, অভিযুক্ত কর্মকর্তা কর নথি সরবরাহের ক্ষেত্রে অনৈতিক আর্থিক লেনদেন করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এজন্য সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় কার্যধারা শুরু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে তাকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে সংযুক্ত করে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
অভিযোগ অনুযায়ী, সহকারী কর কমিশনার জান্নাতুল ফেরদৌস মিতু কর অঞ্চল-৫ এ কর্মরত থাকা অবস্থায় ব্যবসায়ী সালাহ উদ্দিন আহমেদের নিযুক্ত প্রতিনিধি তথা এক আয়কর আইনজীবীর কাছ থেকে ৩৮ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণ করেন। এর বিনিময়ে তিনি ওই ব্যবসায়ীর আয়কর নথির পূর্ববর্তী অধিকাংশ রেকর্ড সরবরাহ করেন।
এমন ঘটনায় প্রমাণিত হয়, রাষ্ট্রীয় রাজস্ব ব্যবস্থার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা যদি আর্থিক স্বার্থকে প্রাধান্য দেন, তাহলে সাধারণ করদাতাদের প্রতি সুবিচার প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
প্রজ্ঞাপনে স্পষ্ট বলা হয়েছে,
১. জান্নাতুল ফেরদৌস মিতুর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা গ্রহণ করা হয়েছে।
২. তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে তার মূল পদে বহাল রাখা সমীচীন নয়।
৩. বরখাস্তকালীন সময়ে বিধি অনুযায়ী তিনি খোরপোষ ভাতা পাবেন।
৪. এই সিদ্ধান্ত অবিলম্বে কার্যকর করা হয়েছে।
জনস্বার্থে গৃহীত এ সিদ্ধান্তকে দেশের প্রশাসনিক মহল স্বাগত জানিয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান বলেন,
“কোনো কর্মকর্তার অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে পুরো সংস্থার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হতে পারে না। আমরা দুর্নীতির বিষয়ে শূন্য সহনশীলতার নীতি অনুসরণ করি। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হবে।”
বাংলাদেশে কর ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আস্থার সংকট বিদ্যমান। অনেক করদাতা অভিযোগ করেন, সঠিক নিয়মে কর দেওয়ার পরও কর্মকর্তাদের অনিয়ম, হয়রানি এবং ঘুষ ছাড়া ফাইল অগ্রসর হয় না।
এই ঘটনা আবারও সেই অভিযোগকে সামনে এনেছে। করদাতারা মনে করছেন, যদি শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকেন, তবে সাধারণ করদাতার স্বচ্ছ সেবা পাওয়ার আশা ক্ষীণ হয়ে যায়।
এই বিধিমালার আলোকে যেকোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে, তদন্ত চলাকালীন সময়ে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা যায়। বরখাস্ত অবস্থায় তিনি মূল বেতন না পেলেও খোরপোষ ভাতা প্রাপ্য হন।
এক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রয়োগ করা হয়েছে। জান্নাতুল ফেরদৌস মিতুর বিরুদ্ধে প্রমাণিত হলে তার চাকরি স্থায়ীভাবে বাতিল হওয়ার পাশাপাশি ফৌজদারি মামলাও হতে পারে।
দুদকের একটি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এনবিআরের অভ্যন্তরে ঘুষ ও দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠেছে, সেটি দুর্নীতি দমন কমিশনের নজরে রয়েছে। প্রয়োজনে দুদক পৃথক তদন্ত শুরু করবে।
বাংলাদেশে কর দপ্তর বহু বছর ধরেই দুর্নীতির কারণে সমালোচিত। প্রায়ই অভিযোগ ওঠে—কর্মকর্তাদের ঘুষ ছাড়া কর ফাইল নিষ্পত্তি হয় না।
- ২০২২ সালে এক কর কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ৫০ লাখ টাকার অনিয়মের অভিযোগ ওঠে।
- ২০২৩ সালে আরও কয়েকজন কর্মকর্তাকে ঘুষ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
- এবার ২০২৫ সালে এ ঘটনা ঘটল, যা অতীতের তুলনায় অধিক আলোচিত হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টেকসই করতে হলে কর আহরণ বাড়ানো অত্যাবশ্যক। কিন্তু দুর্নীতি ও আস্থার সংকটের কারণে রাজস্ব আহরণ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছাতে পারছে না।
স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করলে কর ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব।
ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। অনেকেই লিখেছেন,
- “কর কর্মকর্তারা ঘুষ নিলে সাধারণ মানুষ কেন কর দেবে?”
- “এনবিআরের মতো প্রতিষ্ঠানে কঠোর জবাবদিহিতা দরকার।”
- “দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ছাড়া দুর্নীতি কমবে না।”
যদি অভিযোগ প্রমাণিত হয়, জান্নাতুল ফেরদৌস মিতুকে নিম্নলিখিত শাস্তি দেওয়া হতে পারে—
১. চাকরিচ্যুতি।
২. সরকারি চাকরিতে আজীবন অযোগ্য ঘোষণা।
৩. ফৌজদারি মামলায় জেল জরিমানা।
৪. অর্জিত অনৈতিক সম্পদ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে বাজেয়াপ্ত।
ঘুষের ফলে—
- করদাতারা হয়রানির শিকার হন।
- রাজস্ব কমে যায়।
- কালো টাকার প্রবাহ বাড়ে।
- ব্যবসায়ীরা ন্যায্য সুযোগ হারান।
- রাষ্ট্রীয় আস্থার সংকট গভীর হয়।
১. ডিজিটাল কর ব্যবস্থা: সব ফাইল অনলাইনে জমা ও অনুমোদন।
২. ঘুষবিরোধী হটলাইন: করদাতারা অভিযোগ করলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা।
৩. কঠোর শাস্তি: দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুতির নজির তৈরি।
৪. করদাতাদের সচেতনতা বৃদ্ধি: ঘুষ না দিয়ে নিয়ম মেনে কর দেওয়ার প্রতি উৎসাহ।
কর অঞ্চল-৫ এর সহকারী কর কমিশনার জান্নাতুল ফেরদৌস মিতুর বিরুদ্ধে ওঠা ৩৮ লাখ টাকার ঘুষ কেলেঙ্কারি বাংলাদেশের প্রশাসনিক দুর্নীতির এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। তবে এনবিআরের দ্রুত পদক্ষেপ আশার সঞ্চার করেছে।
করদাতাদের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হলে এ ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। পাশাপাশি স্বচ্ছতা ও প্রযুক্তিনির্ভর কর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নির্ভর করছে সুশাসিত কর ব্যবস্থার ওপর। তাই ঘুষ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে এই লড়াই শুধু প্রশাসনের নয়, বরং সমগ্র জাতির দায়িত্ব।