ঝিনাইদহে অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির অতীত ভূমিকা নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ফের নতুন বিতর্কের জন্ম দিলেন দেশের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেছেন, অতীতে আওয়ামী লীগের বিতর্কিত নির্বাচন এবং জুলাই বিপ্লবের দমন-পীড়নে জাতীয় পার্টি প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছে। এ কারণেই জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের যে দাবি উঠেছে, তার আইনগত দিক খতিয়ে দেখা হবে।
শনিবার (৩০ আগস্ট) ঝিনাইদহে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিক কার্যালয়ের উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “যদি গণহত্যা, সন্ত্রাস ও ফ্যাসিবাদের কারণে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হতে পারে, তবে জাতীয় পার্টি কেন নিষিদ্ধ হবে না? ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত জাতীয় পার্টি দেশের মানুষের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করেছে। তারা জনগণের রক্ত নিয়ে খেলেছে।”
তিনি মনে করিয়ে দেন, জাতীয় পার্টির জন্ম হয়েছিল সামরিক শাসনের ছত্রছায়ায়। জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল, সামরিক আইন জারি, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নির্যাতন এবং জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া—এসবের দায় এ দল এড়াতে পারে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অ্যাটর্নি জেনারেলের এই বক্তব্য দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করবে। বিশেষ করে বর্তমান রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে প্রকাশ্য মন্তব্য নিঃসন্দেহে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে।
অ্যাটর্নি জেনারেল নুরুল হক নুরের ওপর সাম্প্রতিক হামলারও তীব্র নিন্দা করেন। তিনি বলেন, “এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং একটি গভীর চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের অংশ। এই হামলা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক, নিন্দনীয় ও অপরাধমূলক।”
তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সবসময় এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে “মব” বা জনতার উত্তাল ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করা সব সময় সহজ নয়। গত ১৭ বছরের জমে থাকা ক্ষোভ এখন নানাভাবে বিস্ফোরিত হচ্ছে।
রাজনৈতিক অঙ্গনে এই বক্তব্যও ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকের মতে, নুরের ওপর হামলার পেছনে পরিকল্পিত অপশক্তি সক্রিয়। অন্যদিকে কেউ কেউ বলছেন, জনমনে জমে থাকা ক্ষোভ ও উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, “চোরাবালিতে ডুবে যাওয়া এই দেশ আজ এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে চব্বিশের শহিদ আবু সাঈদ, মুগ্ধ ও ওয়াসিমরা জীবন দিয়েছেন। এই নতুন বাংলাদেশে কোনো দুর্নীতিবাজকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেওয়া হবে না। আমরা দুর্নীতিবাজদের মুখোশ উন্মোচন করতে চাই।”
এই বক্তব্যে তিনি দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির ঘোষণা দিয়েছেন। রাজনৈতিক মহল বলছে, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সরকারের জন্য একটি বড় পরীক্ষা।
এদিন ঝিনাইদহে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিক কার্যালয় উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনী আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. এএসএম আমানুল্লাহ, জেলা প্রশাসক আব্দুল আওয়াল, জেলা বিএনপি সভাপতি আব্দুল মজিদ, জেলা জামায়াতের আমির অধ্যাপক আলী আজম মোহাম্মদ আবু বকর, জেলা গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন প্রমুখ।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শিক্ষার প্রসার, আঞ্চলিক পর্যায়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীদের সুযোগ বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা হয়। তবে অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ হয়ে দাঁড়ায় অ্যাটর্নি জেনারেলের রাজনৈতিক মন্তব্য।
বাংলাদেশের সংবিধানে কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার বিষয়টি জটিল প্রক্রিয়া। গণতন্ত্র, বহুদলীয় রাজনীতি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার কারণে দল নিষিদ্ধ করার জন্য সুনির্দিষ্ট আইনি ভিত্তি থাকা প্রয়োজন।
অ্যাটর্নি জেনারেল স্পষ্ট করেছেন যে, জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ করার দাবির আইনগত দিক নিয়ে যাচাই-বাছাই করা হবে। এর মানে হলো—
- আদালতে এ নিয়ে মামলা হতে পারে,
- সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞদের মত নেওয়া হতে পারে,
- আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার বিষয়ক চুক্তির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ হলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন সংকট তৈরি হতে পারে। কারণ দলটি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিল এবং বর্তমানে জাতীয় রাজনীতিতে তাদের প্রভাব আছে।
একই সঙ্গে এটাও সত্য, জাতীয় পার্টি সবসময় আওয়ামী লীগের সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। বিশেষ করে সংসদীয় রাজনীতিতে অনেক সময় ক্ষমতাসীন দলের কৌশলগত অংশীদার হয়েছে। ফলে জাতীয় পার্টির নিষিদ্ধ হওয়া শুধু তাদের অস্তিত্ব নয়, বরং জাতীয় রাজনীতির ভারসাম্যেও প্রভাব ফেলবে।
অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য সাধারণ মানুষের মধ্যেও আলোচনা তৈরি করেছে। অনেকে মনে করেন, অতীতে যারা জনগণের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে তাদের বিচারের আওতায় আনা উচিত। আবার কেউ কেউ মনে করেন, দল নিষিদ্ধের চেয়ে সঠিক বিচার, সত্য উদঘাটন এবং দায়ীদের শাস্তিই হতে পারে উত্তম সমাধান।
ঝিনাইদহে এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধনী মঞ্চ থেকে অ্যাটর্নি জেনারেলের মন্তব্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে তিনি যে ইঙ্গিত দিয়েছেন তা ভবিষ্যতে বড় রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দেবে। একই সঙ্গে নুরুল হক নুরের ওপর হামলা ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের ঘোষণা বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলবে।
বাংলাদেশ আজ এক সংবেদনশীল সময়ে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অন্যদিকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ—সব মিলিয়ে দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি কোন পথে যাবে, তা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।