৩২ বস্তা টাকা, হাজারো চিঠি ও ভক্তদের অগাধ আস্থা
বাংলাদেশের ধর্মীয় ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত স্থান কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদ। দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ এখানে আসেন ইবাদত, মানত, আর্থিক দান ও মানসিক শান্তির খোঁজে। এই মসজিদের দানবাক্স যেন দেশের মানুষের আস্থা, বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিক ভালোবাসার প্রতীক। সময় সময় যখন দানবাক্স খোলা হয়, তখন সেখানে পাওয়া যায় কোটি কোটি টাকা, বৈদেশিক মুদ্রা, স্বর্ণালঙ্কার এমনকি নানা রকম চিঠিও।
সম্প্রতি আবারও এমনই এক ঘটনা ঘটেছে। শনিবার (৩০ আগস্ট) সকাল ৭টার দিকে মসজিদের ১৪টি দানবাক্স খোলা হয়। দীর্ঘ ৪ মাস ১৮ দিন পর দানবাক্স খোলার সময় এবারও মিলে যায় বিপুল পরিমাণ অর্থ—মোট ৩২ বস্তা টাকা। তবে শুধু টাকা নয়, এবার পাওয়া যায় একাধিক চিঠিও। এর মধ্যে একটি চিঠি বিশেষভাবে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
চিঠিতে লেখা—
“হে পাগলা বাবা, তোমার দোয়ার বরকতে নির্বাচন চাই না, আমাদের দরকার ইউনুস সরকার। তুমি দোয়া কর যেন নির্বাচন না হয়। দোয়া রহিল, ইতি সাধারণ জনগণ।”
এমন বার্তা নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কারণ দেশের সাধারণ মানুষের আস্থা যেমন পাগলা মসজিদের ওপর প্রবল, তেমনি এখানে পাওয়া চিঠিগুলো অনেক সময় সামাজিক বাস্তবতা ও রাজনৈতিক মনোভাবের প্রতিফলন হিসেবেও দেখা হয়
প্রায় চারশ’ মানুষ দানবাক্স খোলার কাজে যুক্ত ছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন মসজিদ কমিটির সদস্য, স্থানীয় মাদ্রাসা ও এতিমখানার শিক্ষক-শিক্ষার্থী, জামিয়া এমদাদিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী, এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল অত্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক ও নিরাপদ।
এবার ১৪টি দানবাক্সের পাশাপাশি নতুন করে দুটি দানবাক্স বসানো হয়েছে। কারণ প্রতি দফায় দানকারীদের সংখ্যা ও দানবাক্সে জমে থাকা অর্থ ক্রমশ বাড়ছে। সাধারণত প্রতি তিন মাস অন্তর দানবাক্স খোলা হলেও এবার কিছুটা দেরিতে, অর্থাৎ ৪ মাস ১৮ দিন পর খোলা হয়েছে।
চলতি বছরের ১২ এপ্রিলও পাগলা মসজিদের দানবাক্স খোলা হয়েছিল। তখন পাওয়া গিয়েছিল রেকর্ড পরিমাণ ৯ কোটি ১৭ লাখ ৮০ হাজার ৬৮৭ টাকা। শুধু টাকা নয়, সঙ্গে ছিল বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালঙ্কার। এ থেকেই বোঝা যায়, সাধারণ মানুষ পাগলা মসজিদের প্রতি কতটা আস্থা রাখেন এবং কত বড় পরিসরে এখানে দান করেন।
বছরের পর বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, টাকার পাশাপাশি দানবাক্সে জমা হয় নানা রকম চিঠি। এগুলোতে কখনো মানুষ নিজের ইচ্ছা-অনুরোধ লিখে দেন, কখনো আবার ব্যক্তিগত সমস্যা বা সামাজিক ইস্যু নিয়েও মতামত দেন।
কিন্তু এবারের চিঠিটি বিশেষভাবে রাজনৈতিক। এখানে সরাসরি উল্লেখ করা হয়েছে—“নির্বাচন চাই না, দরকার ইউনুস সরকার।” এটি কেবল একটি সাধারণ মানুষের লেখা চিঠি হলেও এর বার্তা রাজনৈতিক মহলে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
চিঠির ভাষা থেকে বোঝা যায়, এর লেখক কোনো সাধারণ ভক্ত, যিনি আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের জায়গা থেকে নিজের মতামত দিয়েছেন। যদিও এই চিঠি থেকে জাতির অভিন্ন অবস্থান বোঝা যায় না, তবুও এটি মানুষের এক ধরনের ক্ষোভ বা প্রত্যাশার প্রতিফলন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
দানবাক্স খোলার পুরো প্রক্রিয়ায় উপস্থিত ছিলেন:
- অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও দানবাক্স খোলা কমিটির আহ্বায়ক এরশাদুল আহমেদ,
- কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও পাগলা মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ফৌজিয়া খান,
- অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মিজাবে রহমত,
- পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী,
- জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির অধ্যাপক মো. রমজান আলী।
সঙ্গে ছিলেন বিপুল সংখ্যক সেনাবাহিনী, পুলিশ ও আনসার সদস্য। অর্থাৎ দানবাক্স খোলার প্রক্রিয়াটি শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের অংশ হিসেবে পরিচালিত হয়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে পাগলা মসজিদ একটি অনন্য উদাহরণ। দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ এখানে আসেন আল্লাহর রহমত লাভের আশায়। অনেকে মানত করে টাকা দেন, কেউ দেন জাকাত বা সদকা, আবার কেউ দেন বিপদমুক্তির প্রার্থনায়।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষ যখন সংকটে পড়ে তখন কোনো আধ্যাত্মিক জায়গায় নিজের আস্থা স্থাপন করতে চায়। পাগলা মসজিদ সেই বিশ্বাসের জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে এখানে দানের ধারা শুধু আর্থিক অনুদান নয়, বরং মানুষের আবেগ ও বিশ্বাসের প্রকাশ।
যদিও মসজিদ মূলত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, তবে এখানে পাওয়া কিছু চিঠি মাঝে মাঝে রাজনৈতিক বার্তাও বহন করে। এবারের চিঠি তারই একটি উদাহরণ।
বাংলাদেশে বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম এবং নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের মধ্যে এই চিঠি বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের বার্তা জনমতের কিছু ইঙ্গিত দেয়। তবে এটিকে সার্বিক জাতীয় অভিমতের প্রতিফলন হিসেবে দেখা যাবে না।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ইতোমধ্যেই বিষয়টি আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকে লিখছেন, পাগলা মসজিদের প্রতি মানুষের আস্থা অটুট। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, দানবাক্সে রাজনৈতিক চিঠি লেখা একটি অস্বাভাবিক ঘটনা, যা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতিফলন।
পাগলা মসজিদের দানবাক্স শুধু অর্থ নয়, মানুষের ভালোবাসা, বিশ্বাস ও মানসিক আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। কোটি কোটি টাকার পাশাপাশি এখানে পাওয়া চিঠিগুলো সামাজিক বাস্তবতারও প্রতিফলন ঘটায়। এবারের চিঠিতে নির্বাচন না চাওয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক আলোচনায় স্থান করে নিয়েছে।
তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পাগলা মসজিদ বাংলাদেশের মানুষের আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের এক অনন্য কেন্দ্র, যেখানে দানবাক্সে জমা হওয়া অর্থ যেমন কোটি কোটি টাকার, তেমনি ভক্তদের হৃদয়ের টানও অনন্ত।